পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
সদ্য মন্ত্রিত্ব-খোয়ানো পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে দল থেকে সাসপেন্ড করল তৃণমূল। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির বৈঠকে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অভিষেক বলেন, ‘‘তদন্ত যতদিন না শেষ হবে, ততদিন পার্থ চট্টোপাধ্যায় দল থেকে সাসপেন্ড থাকবেন। উনি আইনের চোখে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত করতে পারলে তখন পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’
অভিষেক জানান, বৈঠকে উপস্থিত সকলেই একবাক্যে ওই অভিমত প্রকাশ করেছেন। যে সমস্ত তথ্য সামনে আসছে, তার ভিত্তিতে মুখ্যমন্ত্রীও একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে একইসঙ্গে অভিষেক বলেছেন, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার উচিত দ্রুত তদন্ত শেষ করা! তাঁর কথায়, ‘‘সারদা-কাণ্ডে এখনও বিচার সেভাবে শুরু হয়নি। চার্জশিটও দিতে পারেনি সিবিআই।’’
এরই পাশাপাশি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় অভিষেক জানিয়ে দিয়েছেন, দুর্নীতির সঙ্গে আপস করার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। তাঁর কথায়, ‘‘এই বিষয়ে আমরা জিরো টলারেন্সে বিশ্বাসী!’’ তিনি বলেন, ‘‘এই টাকার সঙ্গে দলের কোনও সম্পর্ক নেই। দলের টাকা হলে তো তা দলীয় দফতর থেকে উদ্ধার করা হত! তা তো হয়নি! ওই টাকা উদ্ধার হয়েছে ব্যক্তিবিশেষের বাড়ি থেকে।’’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসনিক ভাবে এবং অভিষেক সাংগঠনিক ভাবে পার্থ সম্পর্কে যে শাস্তিমূলক সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছেন বৃহস্পতিবার, তা গত ছ’দিনে তৈরি-হওয়া ক্ষত কতটা মেরামত করবে, তা এখনই বলার সময় আসেনি। তবে বিরোধী বিজেপি এবং সিপিএম স্বভাবতই এতে সন্তুষ্ট নয়। সিপিএমের আইনজীবী-সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে অপসারণ করে এই অন্যায় ঢাকা যাবে না।’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের কথায়, ‘‘পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে বলির পাঁঠা করা হল।’’
পার্থকে সাসপেন্ড করা হলেও তৃণমূলের একাংশের মতে, ওই সাসপেনশন আদতে বহিষ্কারেরই নামান্তর। কারণ, যে তদন্ত সবে শুরু হয়েছে, তা কতদিনে শেষ হবে, তা কেউই জানেন না। ফলে কার্যকারণ দেখতে গেলে পার্থ দল থেকে ‘বহিষ্কৃত’ই হলেন। পাশাপাশিই, পার্থকে সরানো হল দলের মুখপত্রের সম্পাদকের পদ থেকেও। পার্থকে ওই পদ থেকে সরানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায়কে দলীয় মুখপত্রের সম্পাদক পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়ে দেওয়া হয় দলের তরফে। অভিষেকের সাংবাদিক বৈঠক শেষ হওয়ার অনতিবিলম্বেই তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল টুইট করে এই খবর দেন। দল থেকে সাসপেন্ড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এমনিতেই পার্থের মহাসচিব পদ-সহ অন্যান্য সব পদ চলে যায়। পার্থ দলের মোট পাঁচটি পদে ছিলেন। ফলে এখন পার্থ আপাতত ‘তৃণমূলের সাসপেন্ডেড বিধায়ক’ হিসেবেই থাকবেন। অভিষেক বলেন, ‘‘এখন তৃণমূলে কোনও মহাসচিব নেই। সিদ্ধান্ত নেবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’’
অভিষেকের কথায়, ‘‘যে সমস্ত ছবি জনসমক্ষে এসেছে, তা অস্বস্তিকর। কিন্তু যত বড়ই নেতা হন, তাঁর যতই জনসমর্থন থাকুক, মানুষের সঙ্গে অন্যায় করলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবেই। আমরা কাউকে আড়াল করব না।’’
অভিষেক বলেন, ওই দুর্নীতির তদন্তের বিষয়ে রাজ্য সরকার ইডি, সিবিআই-সহ সমস্ত তদন্তকারী সংস্থাকে সাহায্য করবে। তাঁর কথায়, ‘‘সাধারণ মানুষের সঙ্গে অন্যায় হলে কোনও আপস করে না তৃণমূল। যদি কেউ অন্যায় করে থাকেন বলে প্রমাণিত হয়, তৃণমূল তাঁকে ছেড়ে দেবে না। কেউ দলের মঞ্চ ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করলে তাঁকে ছেড়ে দেবে না দল!’’
পার্থ গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই তাঁকে মন্ত্রিত্ব-সহ দলের সমস্ত পদ থেকে সরানোর দাবি উঠছিল। অবশেষে গ্রেফতার হওয়ার ছ’দিনের মাথায় সরকার এবং দল তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল। যার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অভিষেক বলেন, ‘‘তৃণমূলকে ব্যবস্থা নিতে একটু সময় তো দিতে হবে। ভারতে একটি রাজনৈতিক দলও নেই, যারা ছ’দিনের মধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছে। কাউকে বাঁচানোর কোনও চেষ্টা করা হচ্ছে না।’’
পার্থ কি কোনও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার? অভিষেক বলেন, ‘‘এই প্রশ্নটা পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে করা উচিত। কিন্তু যে পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ উঠে এসেছে, তাতে তাঁকে নিজেকেই বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে।’’ তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের কথায়, ‘‘মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না। কারও বিরুদ্ধে জনসমক্ষে কোনও প্রমাণ এলে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদিও তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহ রয়েছে, তবুও খতিয়ে দেখুক কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তবে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ বন্ধ করুক ইডি।’’
সকালে কুণালের ‘আক্রমণাত্মক’ টুইট এবং বিকেলে মন্ত্রিত্ব থেকে বাদ পড়ার পর পার্থের মহাসচিব পদ যে যাবে, তা নিয়ে কোনও দ্বিমত ছিল না। আলোচনা হওয়ার ছিল একটি বিষয় নিয়েই— পার্থকে সাসপেন্ড করা হবে নাকি সরাসরি দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। মূলত সেটা আলোচনা করতেই অভিষেকের নেতৃত্বে বৈঠকে বসেছিলেন দলের শীর্ষনেতারা। সেই বৈঠকেই পার্থকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
পার্থের বিরুদ্ধে যে দল শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে চলেছে, তা বৃহস্পতিবার সকালেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল কুণালের আক্রমণাত্মক টুইটে। যেখানে তিনি দাবি তুলেছিলেন, মন্ত্রিত্ব এবং দলের সমস্ত পদ থেকে ছেঁটে ফেলা তো বটেই, প্রয়োজনে পার্থকে দল থেকে বহিষ্কার করা হোক!
কুণালের সেই দাবির অব্যবহিত পরেই জানা যায়, বিকাল ৫টায় তৃণমূল ভবনে দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির বৈঠক ডেকেছেন অভিষেক। সেটিও কুণালই টুইট করে জানান। এ-ও জানান যে, তাঁকেও ওই বৈঠকে থাকতে বলা হয়েছে। ঘটনাচক্রে, ওই শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির প্রধান আবার পার্থ নিজেই! কিন্তু ইডির হাতে গ্রেফতার হওয়ায় তিনি স্বভাবতই বৈঠকে থাকতে পারবেন না। এ-ও এক সমাপতন যে, একদা তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীন শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি তাঁর বিরুদ্ধেই শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ নিয়ে বৈঠকে বসল! সেই বৈঠকেই তাঁকে দলীয় শাস্তির মুখে পড়তে হল। এবং সেই চেয়ারম্যানের পদটিও খোয়াতে হল।
তৃণমূলের ওই কমিটিতে অভিষেক এবং পার্থ ছাড়াও রয়েছেন রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী, রাজ্যের তিন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, অরূপ বিশ্বাস, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং প্রবীণ সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে সংসদের অভিবেশন চলায় সুদীপ আপাতত দিল্লিতে। তাই তিনি ওই বৈঠকে ছিলেন না। প্রসঙ্গত, পার্থ গ্রেফতার হওয়ার পরে তৃণমূলের প্রথম প্রতিক্রিয়া জানানোর আগে অভিষেকের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন ওই তিন মন্ত্রী। সেই বৈঠকটি অবশ্য হয়েছিল অভিষেকের ক্যামাক স্ট্রিটের অফিসে। ছিলেন কুণাল। যেমন তিনি ছিলেন বৃহস্পতিবারের বৈঠকেও। এ ছাড়াও মন্ত্রী ব্রাত্য বসুকেও ওই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ছিলেন মন্ত্রী মলয় ঘটকও।
বৈঠকের আগেই পার্থের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন দলের নেতাদের একটা বড় অংশ। সকালে সেই সুর বেঁধে দিয়েছিলেন কুণাল স্বয়ং। তৃণমূলের অন্দরের দলীয় সমীকরণে রাজ্য সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল যেমন দলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আস্থাভাজন’, তেমনই তিনি অভিষেকেরও ‘ঘনিষ্ঠ’। বস্তুত, দলীয় নেতৃত্বের একাংশ মনে করেন, প্রয়োজনে পার্থের বহিষ্কার দাবি করে কুণালের ওই টুইট দলের শীর্ষনেতৃত্বের বিনা অনুমোদনে ঘটেনি।
ঘটনাপ্রবাহ বলছে, কুণালের টুইটের কয়েক ঘণ্টা পরেই অভিষেক বিকেলে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির বৈঠক ডাকার সিদ্ধান্ত নেন। সেই বিষয়টিও প্রকাশ্যে আসে কুণালেরই টুইটে। ইতিহাস বলছে, তৃণমূলের অন্দরে পার্থের সঙ্গে কুণালের সম্পর্ক বরাবরই ‘মধুর’ থেকেছে। বস্তুত, কয়েক মাস আগে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে পার্থই কুণালকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তিন মাসও গড়ায়নি। ছবিটা একেবারে উল্টো হয়ে গিয়েছে!
কমিটির বৈঠকের পর অভিষেক কেন্দ্রীয় সরকারকেও কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছেন। বিজেপির রাজনৈতিক আক্রমণের মোকাবিলা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একই মঞ্চে কাউকে দেখা গেলেই কিছু প্রমাণিত হয় না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও তো নীরব মোদীর ছবি দেখা গিয়েছে।’’ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অভিষেকের প্রশ্ন, ‘‘এত টাকা কলকাতা পর্যন্ত কী ভাবে এসে পৌঁছল?’’
অভিষেকের আরও বক্তব্য, ‘‘বিরোধী দলনেতার (শুভেন্দু অধিকারী) বিরুদ্ধে ভূরি ভূরি অভিযোগ। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা তাঁর দল নেয় না। বিজেপিতে আছেন বলে তাঁকে ছাড় দেওয়া হয়েছে! কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সকলের বিরুদ্ধে একই ব্যবস্থা নিক! কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেন না।’’ পাশাপাশি অভিষেকের অভিযোগ, সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীও সারদায় অভিযুক্ত। দলের তরফে তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যেমন নেওয়া হয়নি বিজেপির কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের বিরুদ্ধেও। সেই সূত্রেই অভিষেকের বক্তব্য, ‘‘সারা ভারতে আর একটা এমন দল দেখান, যারা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত নিজেদের মন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়েছে, দলের সমস্ত পদ থেকে সরিয়েছে এবং সাসপেন্ড করেছে।’’
অভিষেক জানিয়েছেন, ২২ জুলাই গভীর রাতে পার্থ গ্রেফতার হওয়ার পর ২৩ তারিখে তাঁর দলনেত্রী মমতাকে গোটা পরিস্থিতি লিখিত ভাবে জানিয়েছিলেন। তার আগে তাঁর সঙ্গে আলোচনাও করেছিলেন। এবং নিজেদের মধ্যেও আলোচনা করেছিলেন। তখনই তাঁরা ঠিক করেন, ২৮ তারিখ পরবর্তী বৈঠকে বসে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy