Advertisement
E-Paper

এ বার ‘দুয়ারে ভোট’! সূর্য ওঠার আগেই শাসকের ছাপ্পা ব্যালটে, বাকি সময়ের কাজে ‘পরিযায়ী’ দাপুটেরা

শাসকদলের অন্দরের খবর, দুই কৌশল কাজে লাগিয়ে ২০টি জেলা পরিষদই ঝেঁটিয়ে জেতা কার্যত নিশ্চিত করে ফেলা গিয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, বেলা ৩টের পর নামানো হয়েছিল বাইক-বাহিনীও।

Image of Chappa Vote.

—প্রতীকী চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৩ ১৯:২৫
Share
Save

নতুন ভোট। নতুন কৌশল। বাংলায় প্রতি বারের ভোটে শাসক শিবির (বাম আমলে সিপিএম বা এই আমলে তৃণমূল) নতুন কৌশল আমদানি করে। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে দু’টি নতুন কৌশল নিয়ে এল তৃণমূল। এক, ভোট শুরুর আগেই ভোট শেষ! দুই, গোটা রাজ্যে ‘পরিযায়ী’ ডাকাবুকো সৈনিক পাঠানো। যেমন ধরা যাক, উত্তর ২৪ পরগনার লোক ‘ভোট করাতে’ যাবে হুগলিতে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার লোক যাবে পূর্ব মেদিনীপুরে। মালদহের লোক যাবে জলপাইগুড়িতে। আবার উত্তর দিনাজপুরের লোক যাবে মুর্শিদাবাদে।

শাসকদলের অন্দরের খবর, গোলমাল যা-ই হোক না কেন, এই দুই কৌশল কাজে লাগিয়ে ২০টি জেলা পরিষদই ঝেঁটিয়ে জেতা কার্যত নিশ্চিত করে ফেলা গিয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, ওই দুই কৌশলের পাশাপাশি বেলা ৩টের পর নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাইক-বাহিনীও। অনেকের মতে, যে নিপুণ দক্ষতায় এ বারে নির্বাচনে বহিরাগত বাহিনীকে মোতায়েন করে শাসকদল ‘ভোট করিয়েছে’, তা বাম জমানার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।

যদিও তৃণমূলের মুখপাত্র তাপস রায় বলেছেন, ‘‘এমন সব ভিত্তিহীন অভিযোগের কী আর উত্তর দেব! ভোটের ময়দানে না পেরে এই রকম নানা সারবত্তাহীন অভিযোগ দীর্ঘ দিন ধরেই বিরোধীরা করে আসছেন। এটা সে রকমই একটি অভিযোগ। নির্বাচনের আগের দিন রাতে ভোট হয়ে গিয়েছে, এ রকম কখনও শুনিনি!’’

বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘তৃণমূলের একটা ‘পবিত্র’ লক্ষ্য রয়েছে— যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় থাকা। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা বিনিয়োগ করেছিলেন, ক্ষমতায় থেকে পরবর্তী প্রজন্মকে তা সুদে-আসলে পাইয়ে দিতে চান। সেই কারণেই প্রতি বার কৌশল বদলাচ্ছে তৃণমূল। গত বার মনোনয়ন কেন্দ্র আর গণনা কেন্দ্রে লুট চালিয়েছিল। এ বার পাখি ডাকার আগেই ব্যালট ছিনতাই করেছে।’’ সিপিএম নেতা শমীক লাহিড়ি অবশ্য এটি ‘কৌশল’ বলে মানতে চাননি। তাঁর কথায়, এটা ‘ছল’। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এই সদস্যের কথায়, ‘‘ডাকাতেরা কৌশল নেয় না। ছল-কপটতা করে। আর এই ভোট-ডাকাতি হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায়। কারণ, পঞ্চায়েত মানে তৃণমূলের লোকেদের করে খাওয়ার জায়গা। আর তার থেকে কমিশন নেবেন বলে নির্বাচন কমিশনার শনিবার দিনভর ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসেছিলেন।’’ কংগ্রেসের আইনজীবী-নেতা কৌস্তভ বাগচী বলেন, ‘‘তৃণমূল যে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, সেই গণতন্ত্রই ভোটের আগে থেকে রাজ্য জুড়ে দেখা গিয়েছে। ওরা তো ভোটে বিশ্বাস করে না! তাই আগের দিন রাত থেকেই ভোট লুট করতে নেমে পড়েছিল।’’

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েতের ভোটের মতো এ বার মনোনয়ন পেশে বাধা দেওয়া হবে না বিরোধীদের। সেই ‘প্রতিশ্রুতি’ যে শাসকদলের নেতা-কর্মীরা অনেকাংশে পালন করেছেন, জেলায় জেলায় মনোনয়ন জমার পরিসংখ্যান থেকেই তা স্পষ্ট। কিন্তু গ্রামবাংলার ভোটারদের একটা বড় অংশ বুঝতেই পারেননি, ভোটের দিন বুথে গিয়ে ফাঁকা ব্যালট পেপার পাবেন না তাঁরা!

শনিবার রাজ্যের বিভিন্ন জেলার একাধিক বুথে এমন ঘটনা ঘটেছে। এই দৃষ্টান্ত যে অতীতে ছিল না, এমন নয়। কিন্তু খুচখাচ কিছু সীমিত এলাকায়। অতীতে তৃণমূলের এক প্রভাবশালী নেতা পুরসভা-পঞ্চায়েত স্তরে এমন কৌশলে ভোট করিয়েছিলেন। কিন্তু তা নেহাতই সীমাবদ্ধ পরিসরে। এ বার সেটিই হয়েছে ব্যাপক হারে! কোথাও গভীর রাতে, কোথাও সূর্যোদয়ের আগেই বিভিন্ন বুথ থেকে গোছা গোছা ব্যালট পেপার তুলে আনা হয়েছিল বাড়িতে বা তৃণমূলের স্থানীয় অফিসে। ভোট শুরুর পর বুথে গিয়ে ভোটদাতারা হয় শুনেছেন, ভোট পড়ে গিয়েছে, নয়তো তৃণমূলের প্রতীকে আগে থেকেই ছাপ-মারা ব্যালট তাঁদের হাতে ধরিয়ে সেটি ব্যালট বাক্সে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এই পরিকল্পনা করা হয়েছিল প্রায় নিখুঁত দক্ষতায়। শাসকদলের অন্দরের খবর, প্রথমে ঠিক হয়েছিল গভীর রাতে গিয়ে বিভিন্ন বুথের প্রিসাইডিং অফিসার এবং ভোটকর্মীদের ‘বাগে আনা’ হবে। সেই কাজে লাগানো হবে বিশেষ বাহিনী। তারাই গিয়ে ব্যালট পেপার নিয়ে এসে রাত থেকে ভোরের আগে পর্যন্ত ছাপ্পা মেরে যাবে। তার পরে ভোরের আগে আবার সেগুলি পৌঁছে দেওয়া হবে বুথে বুথে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ছাপ-মারা ব্যালট পেপার ব্যালট বক্সেও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তেমন যে হয়েছিল, তা প্রকাশ্যেই স্বীকার করে নিয়েছেন একাধিক ভোট আধিকারিক। বীরভূমের একটি বুথের প্রিসাইডিং অফিসার শনিবার সকালে জোর করে ব্যালটের গোছা নিয়ে গিয়ে ছাপ মারার অভিযোগ তুলেছেন। তাঁর দাবি, যাঁরা ওই কাজ করেছেন, তাঁরা শাসকদলের কর্মী বলেই নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন। কয়েকটি ক্ষেত্রে ক্ষিপ্ত ভোটারেরা আগে থেকে ছাপ-মারা ব্যালট পেপারের গোছায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন। আধপোড়া ব্যালট পেপার হাতে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, প্রতিটিতেই তৃণমূলের প্রতীকে ছাপ মারা রয়েছে।

প্রচুর এলাকায় সূর্যোদয়ের আগে কাজ সেরে ফেলেছিল শাসকদল। কিন্তু বাকি দিনের জন্য অন্য জেলা থেকে ‘দাপুটে এবং ডাকাবুকো’ লোক নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ‘পরিযায়ী’ শ্রমিকদের মতো। বিরোধীদের অভিযোগ, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় অভিষেকের কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারে ওই কৌশল নেওয়া হয়েছিল। সেখানে অনেক পঞ্চায়েতে আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছিল তৃণমূল। অন্য বেশ কিছু এলাকায় শনিবার সকাল ৭টায় আনুষ্ঠানিক ভোটগ্রহণ শুরুর আগেই ছাপ্পা মারা ব্যালট বাক্সে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। দিনের বাকি সময়ে কাজে লাগানো হয় অন্য জেলা থেকে নিয়ে-আসা ‘বাহিনী’কে। অনেক ক্ষেত্রে তৃণমূলের স্থানীয় লোকজনও সে কথা জানতে পারেননি।

অভিযোগ, ‘পরিযায়ী’ বাহিনী কাজে লাগানো হয়েছে ডায়মন্ড হারবারের গঙ্গার উল্টো পারে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায়। সেখানে ভোটের আগেই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অভিযোগ করেছিলেন, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ জেতা বিভিন্ন এলাকা থেকে হুগলি নদী পার হয়ে ভোটের দিন ঢুকবে শাসকদলের বাহিনী। শুভেন্দু তা রোখার ডাক দিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাতে ‘ফল’ মেলেনি বলে জেলা বিজেপির এক নেতা স্বীকার করে নিয়েছেন। বস্তুত, শুভেন্দুও ভোটপর্ব চলাকালীন ‘কালীঘাট চলো’র ডাক দিয়ে কার্যত সেই অভিযোগই স্বীকার করে নিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

শুধু পূর্ব মেদিনীপুর নয়, ‘গঙ্গাপারের’ ঘটনা ঘটেছে হুগলিতেও। অভিযোগ, কোন্নগরের নবগ্রাম এলাকায় মোতায়েন ছিল ব্যারাকপুর-টিটাগড় থেকে আনা বাহিনী। হাওড়ার সালকিয়ার নন্দীবাগান এলাকা থেকে বাহিনী গিয়েছিল ডোমজুড়, মাকড়দহ এলাকায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় তৃণমূল কর্মীরাও এ বিষয়ে কিছুই জানতে পারেননি তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর। ওই সূত্রের খবর, হুগলির শিল্পাঞ্চল থেকে ‘ভোট করতে’ ধনিয়াখালিতে পাঠানো হয়েছিল ‘তৃণমূলের বাছাই করা কর্মীদের’। সেখানকার একটি বুথে শনিবার কাকভোরে যখন ব্যালটের গোছায় ছাপ মারার কাজ চলছিল, হঠাৎই দাঁত মাজতে মাজতে হাজির স্থানীয় এক তৃণমূল কর্মী। অবাক হয়ে তিনি দেখেন, অচেনা কিছু মুখ ছাপ মেরে চলেছে জোড়াফুল প্রতীকে!

বস্তুত, বিজেপি, বাম এবং কংগ্রেস— সব বিরোধী পক্ষই শনিবার পঞ্চায়েত ভোটকে একসুরে ‘প্রহসন’ আখ্যা দিয়ে প্রতিবাদের ডাক দিয়েছে। শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বের অবশ্য পাল্টা দাবি, রাজ্যে মোট ৪০ হাজারেরও বেশি ভোটকেন্দ্রে ভোট হয়েছে, তার মধ্যে অশান্তির অভিযোগ এসেছে বড়জোর গোটা পঞ্চাশেক বুথে।

West Bengal Panchayat Election 2023 ruling party

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}