জয়োল্লাস: ভোটগণনা কেন্দ্রের বাইরে উদ্যাপন তৃণমূল কর্মীদের। ছবি পিটিআই।
কলকাতার পরে এ বার রাজ্যের অন্য চারটি পুর-নিগমও জিতে নিল তৃণমূল কংগ্রেস। চারটির মধ্যে বিধাননগর, আসানসোল ও চন্দননগর ছিল শাসক দলেরই হাতে। আসন ও ভোট বাড়িয়ে ওই তিনটি পুর-নিগমই দখলে রাখল তারা। সেই সঙ্গে শাসক দলের ঝুলিতে নতুন সংযোজন শিলিগুড়ি। যেখানে এ বারই প্রথম বোর্ড গড়ছে তৃণমূল। চার পুর-এলাকাতেই ধরাশায়ী হয়েছে বিজেপি। দাগ কাটতে পারেনি অন্য বিরোধীরাও।
রাজ্যে গত বছরের বিধানসভা নির্বাচন থেকেই তৃণমূলের যে জয়ের ধারা চলছে, সোমবার পুরভোটের ফলে তার গতিই আরও তীব্র হয়েছে। বিধানসভা ভোটের পরে কয়েকটি উপনির্বাচনে জয়ের ধারা ধরে রেখেছিল তৃণমূল, সেই পথ ধরেই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তারা জয়ী হয়েছিল কলকাতা পুরসভায়। দু’মাসের মধ্যে সেই জয়ের হাওয়া এমন ঝড়ে পরিণত হয়েছে, যার দাপটে শিলিগুড়ির পুরবোর্ডও চলে এসেছে তৃণমূলের দখলে। গত বার যা ছিল বামেদের হাতে। শাসক দলের শীর্ষ স্তরে সাম্প্রতিক যে বিভাজন নিয়ে চর্চা চলেছে, তার কোনও প্রভাব অন্তত চার জেলার এই চার পুর-নিগমের নির্বাচনের ফলে পড়েনি।
বিধানসভা ভোটে রাজ্যে বিপর্যয়ের মুখে পড়লেও আসানসোল ও শিলিগুড়িতে প্রভাব ধরে রাখতে পেরেছিল বিজেপি। তাদের বিধায়কও নির্বাচিত হয়েছিলেন ওই এলাকা থেকে। এ বারের পুরভোটে ওই দুই পুর-এলাকাতেও দাপট বিস্তার করেছে তৃণমূল। তবে মূলত অবাঙালি-অধ্যুষিত কিছু এলাকার জোরে আসানসোল ও শিলিগুড়ি পুরসভায় দ্বিতীয় স্থান রাখতে পেরেছে বিজেপি। চন্দননগর ও বিধাননগরে তারা নেমে গিয়েছে তৃতীয় স্থানে, সেখানে দ্বিতীয় বামেরা। কয়েক বছর ধরে বামেদের ভোটের বড় অংশ বিজেপির দিকে চলে যাওয়ার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল, সাম্প্রতিক কালে আবার তার উল্টো ধারায় কিছুটা ভোট বামেদের দিকে ফেরার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। চার পুর-নিগমেও কিছু ক্ষেত্রে ভোট আংশিক ভাবে ফেরাতে পেরেছে বামেরা, আবার বিজেপি থেকে ভোট চলে গিয়েছে তৃণমূলের দিকেও। ফলে, দু’দিক থেকেই ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি।
বিরোধীরা অবশ্য অভিযোগ করছে, পুরভোটের এই ফল জনমতের ‘সঠিক প্রতিফলন’ নয়। ভোট ‘লুঠের’ জোরেই এত বেশি আসন ও ভোট পেয়েছে শাসক দল। বিধাননগর ও আসানসোলেই বিরোধীদের অভিযোগের মাত্রা বেশি। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদিও দাবি করেছেন, ভোট ছিল একেবারে শান্তিপূর্ণ। মানুষ তৃণমূলের উপরে ভরসা রেখেছেন।
চার পুর-নিগমে এ দিনের ভোট-গণনার তথ্য বলছে, মোট ২২৬টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৯৮টিতেই জয়ী হয়েছে তৃণমূল। বিরোধীদের মধ্যে বিজেপি মোট ১২, বামফ্রন্ট ৭ এবং কংগ্রেস ৫টি ওয়ার্ড পেয়েছে। নির্দল প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন ৪টি ওয়ার্ডে। সব ক্ষেত্রেই প্রথম স্থানে থাকা তৃণমূলের সঙ্গে দ্বিতীয় স্থানের ব্যবধান দুস্তর! চার পুরসভায় যে দল যত ভোট পেয়েছে, তার গড় হিসেব করলে তৃণমূল পেয়েছে ৬০.৫৪%। এই হিসেবে বিজেপির চেয়ে সামান্য বেশি পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে বামেরা। তাদের প্রাপ্ত ভোট ১৬.১২%, বিজেপির ভোট ১৪.৬০%। কংগ্রেসের প্রাপ্তি ৩.৬১%। আর নির্দল-সহ অন্যান্যদের বাক্সে গিয়েছে ৪.৩০%। অর্থাৎ আসন বা ভোট-প্রাপ্তি, যে কোনও মাপকাঠিতেই তৃণমূলের থেকে বাকিদের দূরত্ব অনেক।
বিপুল জয়ের পরে আরও ‘নম্র ও দায়িত্বশীল’ হয়ে কাজ করার জন্য দলকে বার্তা দিয়েছেন মমতা। উত্তরবঙ্গ সফরে যাওয়ার আগে এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘আবার এই বিরাট জয় মা-মাটি-মানুষের। তৃণমূলের প্রার্থীদের উপরে আস্থা ও বিশ্বাস রাখার জন্য আসানসোল, বিধাননগর, শিলিগুড়ি এবং চন্দনগরের মানুষকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘মা-মাটি-মানুষকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলছি, উন্নয়নের কাজ আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উৎসাহ ও তাগিদ আমাদের বেড়ে গেল।’’ ভোটের ফলপ্রকাশের পরেই মমতা ঘোষণা করে দিয়েছেন, প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম দেব শিলিগুড়ির মেয়র হবেন। বাকি পুরবোর্ডগুলির শীর্ষে কে বসবেন, তা আলোচনা করে ঠিক হবে।
চার পুর-নিগমের মধ্যে বিধাননগরের রাজনৈতিক সমীকরণ নিয়ে সব চেয়ে বেশি চর্চা ছিল। সেখানে ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৯টিই জিতেছে তৃণমূল। বিরোধী বাম ও বিজেপি কোনও আসনই পায়নি। কংগ্রেস ধরে রাখতে পেরেছে তাদের একটি পুরনো ওয়ার্ড। আরও উল্লেখযোগ্য তথ্য, গত ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে বিধাননগর বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি এগিয়েছিল প্রায় ১৯ হাজার ভোটে। গত বছর বিধানসভা নির্বাচনে সেই ব্যবধান মুছে তৃণমূল জয়ী হয়েছিল ৭ হাজারেরও বেশি ভোটে। বিধাননগর পুরসভার যে ১৪টি ওয়ার্ড ওই বিধানসভার মধ্যে পড়ে, তার নিরিখে তৃণমূল এগিয়েছিল কয়েকশো ভোটে। আর এ বার ওই ১৪টি ওয়ার্ডেই শাসক দলের জয়ের ব্যবধান প্রায় ৫০ হাজার! কয়েক মাস আগে বিজেপি থেকে তৃণমূলে ফিরিয়ে এনে বিধাননগরের পুরভোটে তাঁর পুরনো ওয়ার্ড থেকেই সব্যসাচী দত্তকে প্রার্থী করেছিলেন মমতা। এ বারের বিপুল ভোট-বৃদ্ধির প্রসঙ্গে সব্যসাচীর বক্তব্য, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নের প্রতিফলন। তাঁর কাজে এবং আদর্শে আস্থা রেখেছেন মানুষ, তাই এই ফলাফল।’’
একই ভাবে চন্দননগর পু-এলাকায় গত বিধানসভা ভোটে তিনটি ওয়ার্ডে এগিয়েছিল বিজেপি। এ বার বিজেপি সেখানে একটি ওয়ার্ডও জেতেনি। নামমাত্র একটি ওয়ার্ড সিপিএমের দখলে গিয়েছে। রাজ্যের মন্ত্রী ও চন্দননগরের বিধায়ক ইন্দ্রনীল সেনের মতে, ‘‘মা-মাটি-মানুষের জয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর কাজের উপরে মানুষ আগেও আস্থা রেখেছিলেন, এ বার রেখেছেন, আগামী দিনেও রাখবেন।’’ গত দেড় মাস চন্দননগরে ঘাঁটি গেড়ে পড়েছিলেন ইন্দ্রনীল। দলের দেওয়া দায়িত্ব পালনে এ বার তিনি যাচ্ছেন ভদ্রেশ্বর পুরসভার ভোট দেখভাল করতে। একই ভাবে শিলিগুড়িতে পরিশ্রমের ফসল তুলতে পেরেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত আর এক মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। শিলিগুড়িতে দায়িত্ব সেরে কলকাতায় ফিরে তিনি বলেছিলেন, তাঁর অনুমান সেখানে তৃণমূল অন্তত ৩৭টি আসন পাবে। বাস্তবে হয়েছেও তা-ই!
বিরোধীরা অবশ্য ভোটের দিনের মতোই শাসক দলের ‘গা-জোয়ারি ও ভোট লুঠে’র দিকে আঙুল তুলেছে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের মন্তব্য, ‘‘ভোটই হয়নি! লোকসভা, বিধানসভা ভোটে এলে বোঝা যাবে।’’ দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষেরও বক্তব্য, ‘‘ভোটে, প্রচারে, মনোনয়নে হিংসা হয়েছে। ভোট লুঠ করা হয়েছে। প্রার্থীকে, ভোটারদের আটকানো হয়েছে। বীরভূম থেকে লোক নিয়ে গিয়ে আসানসোলে ভোট লুঠ করা হয়েছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে লোক নিয়ে গিয়ে বিধাননগরে ভোট লুঠ করা হয়েছে।’’ তবে পুরভোটে ফের বিপর্যয়কে হাতিয়ার করে বিজেপি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন দলের বিক্ষুব্ধেরা।
রাজ্যে ১০ মাস আগের বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় প্রথমে কলকাতা পুরসভা এবং তার পরে চার পুর-নিগমে বামেদের ভোট আংশিক পুনরুদ্ধারে লড়াইয়ের রসদ খুঁজছেন সিপিএম নেতৃত্ব। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রবীন দেবের বক্তব্য, ‘‘ভোট-প্রাপ্তির দিক থেকে আমাদের ধীরে হলেও স্থিতিশীল একটা উন্নতি ঘটছে। কিন্তু ভোট বাড়লেও সেটা ওয়ার্ড জয়ে কেন রূপান্তরিত হচ্ছে না, সেই বিষয়টা বিশ্লেষণ করতে হবে।’’ সিপিএমের আর এক নেতা সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘বিধাননগর ও আসানসোলে বেশি অন্যায়, ভোট লুঠ হয়েছিল, সেখানে বামেরা বেশি বিপন্ন। চন্দননগর ও শিলিগুড়িতে ছবিটা একটু আলাদা। গত বিধানসভা ভোটের সঙ্গে তুলনা করে দেখলে স্পষ্ট হচ্ছে, সবুজের আড়ালে রাজ্যে যে গেরুয়া ছাপ দেখা যাচ্ছিল, সেটা মুছে যাচ্ছে। মানুষের পাশে থেকে লড়াইয়ে আছে ও থাকবে বামপন্থীরাই।’’
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী সরাসরিই বলেছেন, ‘‘বহু জায়গায় ভোট লুঠ হয়েছে, প্রার্থীদের পর্যন্ত বাধা দেওয়া হয়েছে। এই ফল মানুষের রায়ের ঠিক প্রতিফলন নয়। আমরা সাধ্যমতো যেখানে যতটা পেরেছি, লড়াই করেছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy