আসানসোলে বিজেপি কার্যালয়ে আগুন। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র।
মালদহের পরে আসানসোল। হকার উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে ফের উত্তপ্ত জেলা শহর। এ বার গুলি না চললেও আগুন জ্বলেছে বিজেপি পার্টি অফিসে। এবং তার সূত্র ধরে শুরু হয়ে গিয়েছে তৃণমূল-বিজেপি চাপানউতোর। প্রশ্ন উঠেছে, যে হকারেরা বেআইনি ভাবে রেলের এলাকা দখল করে আছে, তাদের উচ্ছেদ নিয়ে তুলকালামের পিছনে কি রয়েছে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতিই?
বর্তমান শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে হকারদের নিয়ে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির করার অভিযোগ অবশ্য বহু দিনের। বাম জমানায়, ১৯৯৬ সালে ‘অপারেশন সানশাইন’ নাম দিয়ে কলকাতার ফুটপাথ থেকে যখন হকার উচ্ছেদ শুরু হয়, তখন হকারদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তত্কালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি যে অবস্থান বদলাননি, সেটা আর টের পাওয়া গিয়েছে প্রায় দু’দশক পরে, এ বছর কলকাতা পুরভোটের মুখে। হকারদের আইনি স্বীকৃতির পাশাপাশি একগুচ্ছ আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন তিনি।
স্টেশনে জবরদখল করে থাকা হকারদের উচ্ছেদ নিয়েও যে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হতে পারে, সেটা বোঝা গিয়েছিল সোমবার। মালদহে হকার ও আরপিএফের মধ্যে দক্ষযজ্ঞ বাধে। পরের দিন, মঙ্গলবার আরপিএফের হকার উচ্ছেদের ‘জুলুমের’ দোহাই দিয়ে নদিয়ার রানাঘাটে বিক্ষোভ দেখিয়ে স্টেশন চত্বরে দোকানপাট বন্ধ রেখেছিলেন হকারেরা। বুধবার, সেই উচ্ছেদের সুতোয় জড়িয়ে গেল আসানসোলও।
হকারদের পুনর্বাসন এবং একই সঙ্গে রেল পুলিশের ‘জুলুমের’ বিরুদ্ধে কিছু দিন ধরেই সরব হয়ে ওঠা আসানসোল স্টেশনের হকাররা এ দিন সকালে মিছিল করে আসেন জিটি রোড ঘেঁষা শহরের বাজার এলাকায়। রাস্তার ধারে ছিল বিজেপি-র একটি দলীয় কার্যালয়। ক্ষুব্ধ হকাররা আগুন ধরিয়ে দেন তাতে।
এই ঘটনার পরে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, গত লোকসভা ভোটে আসানসোলে জমি হারানো তৃণমূল কি তবে হকারদের উস্কে ফের ভিত শক্ত করতে চাইছে? কারণ, ঘটনার পরে বিজেপি অভিযোগ করেছে, শাসক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা আসনসোল স্টেশনের হকার ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরাই এ কাজ করেছে। পাল্টা অভিযোগে তৃণমূল স্বাভাবিক ভাবেই আঙুল তুলেছে স্থানীয় সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র দিকে। তাদের বক্তব্য, বিজেপির মজদুর সংগঠনের সমর্থকেরা বাবুলের উপরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে এই কাজ করেছে।
বাবুল কিন্তু ‘সব কিছু রাতারাতি মিটিয়ে দেব’ বলে কোনও পরিচিত আশ্বাসের পথে হাঁটেননি। তিনি স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘দেখছি-দেখব রাজনীতি আমি করি না। আমি কিংবা প্রধানমন্ত্রী কেউই ভেল্কি জানেন না যে রাতারাতি হকারদের সমস্যা মিটিয়ে দেবেন।’’ তবে হকারদের সমস্যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে আলোচনার আশ্বাস দিয়েছেন আসানসোলের সাংসদ।
হকার সমস্যা যে দীর্ঘকালীন এবং এক কথায় তার সমাধান করা সম্ভব নয়, সেটা শাসক দলের কোনও কোনও নেতা মেনেও নিয়েছেন। এক জন তো বলেছেন, ‘‘বাবুল সদ্য মন্ত্রী হয়েছেন। তাই ফাঁকা আশ্বাসের রাস্তায় হাঁটেননি। ক্ষোভের আঁচ তাই সরাসরি তাঁর উপরেই পড়ছে।’’ কিন্তু এই ক্ষোভ যে সুকৌশলে তাঁদের দলের অন্য নেতানেত্রীরা ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে, তার কোনও জবাব তিনি দেননি।
কেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ? রাজনীতিকদের অনেকেই বলছেন, অতীতের তো বটেই, সাম্প্রতিক ঘটনা পরম্পরা দেখলেও তাদের দিকেই আঙুল ওঠে। কী ভাবে? তাঁরা উদাহরণ দিচ্ছেন মালদহের। তাঁদের বক্তব্য, ওই ঘটনায় ভিডিও ফুটেজে স্পষ্টই দেখা গিয়েছিল কারা তাণ্ডব চালাচ্ছে। তবু মারমুখী সেই হকারদের গ্রেফতারের সাহস দেখায়নি পুলিশ। কেন? জেলা পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবাব, ‘‘ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে।’’ মালদহের পূর্ব রেলের ডিআরএম রাজেশ অর্গল দায় সারছেন, ‘‘পুলিশ প্রশাসন তাদের মতো কাজ করছে।’’
দিন কয়েক আগে, উত্তর ২৪ পরগনার টিটাগড়ের কাছে কাক-ভোরের প্রথম লোকালে বিস্ফোরণে গুরুতর জখম হয়েছিলেন ১৫ জন যাত্রী। রেল-কর্তারা স্টেশনে গেলে, স্থানীয় মানুষ তাঁদের ঘিরে ধরে দাবি জানান, স্টেশন এলাকায় দুষ্কৃতীদের আনাগোনা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। স্টেশনে বেআইনি দখলদার উচ্ছেদের নির্দেশ এসেছিল তার পরেই।
মৌচাকে ঢিল পড়তেই নেতাদের একাংশ রে-রে করে উঠেছিলেন। রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, দিল্লিতে রেল কর্তাদের কাছেও ঘন ঘন ফোন গিয়েছিল নির্দেশ প্রত্যাহারের আর্জি জানিয়ে। পূর্ব রেলের এক কর্তার দাবি, টিটাগড়ের তৃণমূল সাংসদ তথা প্রাক্তন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী তাঁকে ফোন করে ‘পুনর্বাসন না দিয়ে উচ্ছেদ করলে ধর্না শুরু করবেন হকারেরা’ বলেও প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। দীনেশবাবু কোনও রাখঢাক না রেখেই বলছেন, ‘‘ট্রেনে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না রেল দফতর। তাই এখন হকারদের উপরে দায় চাপাচ্ছে।’’ কিন্তু বেআইনি দখলদারদের পুনর্বাসন দেওয়া কি রেলের পক্ষে সম্ভব? প্রাক্তন রেলমন্ত্রী বলছেন, ‘‘সেটা রেলের ভাবনা।’’ তবে, টিটাগড়ে উচ্ছেদে দাঁড়ি পড়ে গিয়েছিল তার পরেই।
হকার-স্বার্থকে কম গুরুত্ব দিচ্ছেন না প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ ও দীর্ঘ দু-দশক ধরে রেলের স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান বাসুদেব আচারিয়া। বলছেন, ‘‘রেলের জমি দরকার এটা ঠিক। কিন্তু হকারদেরও তো ব্যবসার প্রয়োজন রয়েছে।’’
তাঁর দাবি, তিনি চেয়ারম্যান থাকাকালীন ঠিক হয়েছিল, রেলের জমিতে ব্যবসা করা হকারদের তালিকা তৈরি করে তাঁদের লাইসেন্স দেওয়া হবে। তাঁর দাবি, ‘‘কেন্দ্রে সরকার বদলের পরে তা আর এগোয়নি।’’ আর এক প্রাক্তন রেল-প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীও মনে করেন, ‘‘গায়ের জোরে নয়, আলোচনাই হকার সমস্যার একমাত্র উপায়।’’
যা শুনে বাবুলের প্রশ্ন, ‘‘সব কিছুতেই রাজনৈতিক খেলা না খেললেই নয়, যুক্তি দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করে দেখলে হয় না?’’
প্রশ্ন, সে কথা শুনছে কে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy