Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

মৃত্যুর হাহাকার নেই, জীবিত শবরপল্লির চিন্তা শুধু দু’মুঠো ভাত

গোটা শবর পাড়াটাই যেন এক নেই রাজ্য! পাকা বাড়ি নেই বললেই চলে। জলের পাম্প বহু দিন বিকল। বেশিরভাগ বাসিন্দার ভোটার কার্ডও নেই। জবকার্ড আছে বটে, কিন্তু একশো দিনের কাজে উৎসাহ নেই শবরদের।

আর্ত: জঙ্গলখাসে বাসনা শবর (উপরে)। মৃত কিসান শবরের স্ত্রী খুকুমণি ও ছেলে পূর্ণ (নীচে, বাঁ দিকে)। ত্রাণের চাল বাছছেন মৃত মঙ্গলের বাবা চুনু শবর (ডান দিকে)। লালগড়ের পূর্ণাপাণি গ্রামে। ছবি: দেবরাজ ঘোষ

আর্ত: জঙ্গলখাসে বাসনা শবর (উপরে)। মৃত কিসান শবরের স্ত্রী খুকুমণি ও ছেলে পূর্ণ (নীচে, বাঁ দিকে)। ত্রাণের চাল বাছছেন মৃত মঙ্গলের বাবা চুনু শবর (ডান দিকে)। লালগড়ের পূর্ণাপাণি গ্রামে। ছবি: দেবরাজ ঘোষ

কিংশুক গুপ্ত
ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৮ ১০:১১
Share: Save:

চকচকে পিচ রাস্তা। বাড়ি-বাড়ি বিদ্যুৎ। একশো মিটার অন্তর জলের কল। রাস্তার দু’ধারের বাড়িগুলিতে শ্রীবৃদ্ধির ছাপ। হোঁচট খেতে হয় কেবল শবরপল্লিতে পৌঁছে।

লালগড়ের পূর্ণাপাণি গ্রামে ৯৭টি পরিবারের বাস। এর মধ্যে জঙ্গলখাস মৌজায় আছে ৩৫টি শবর পরিবার। এখানেই গত ১৫ দিনে ৭ জন শবরের মৃত্যু হয়েছে। সেই খবরে আলো়ড়নও পড়েছে। মঙ্গলবার গ্রামে পৌঁছন জেলাশাসক, পুলিশ সুপার। ত্রাণ নিয়ে আসেন শাসক দলের নেতারও ।

তবে শবরপল্লিতে আলোড়নের ছিটেফোঁটা নেই। দিনান্তে দু’মুঠো ভাত জোগাড়ের চিন্তাতেই দিশাহারা তারা।

গোটা শবর পাড়াটাই যেন এক নেই রাজ্য! পাকা বাড়ি নেই বললেই চলে। জলের পাম্প বহু দিন বিকল। বেশিরভাগ বাসিন্দার ভোটার কার্ডও নেই। জবকার্ড আছে বটে, কিন্তু একশো দিনের কাজে উৎসাহ নেই শবরদের। মৃত কিসান শবরের স্ত্রী খুকুমণি বললেন, ‘‘ও কাজে অনেক ঝামেলা। হাতে টাকা পাওয়া যায় না। ডালপাতা কুড়নোই ভাল।’’

আরও পড়ুন: কতটা ফাঁপা উন্নয়ন, বোঝা যাচ্ছে মৃত শবরদের গ্রামে পা রাখলেই

এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের যে বাড়তি তাগিদটা লাগে, তার অভাব রয়েছে বলেই অভিযোগ। আর তাই শবরপাড়ার বহু ছেলেমেয়ে স্কুলে যায় না, অসুখ করলে নিয়ে যাওয়া হয় না হাসপাতালে। কয়েক বছর আগে জন্ডিস হয়েছিল মৃত কিসান শবরের। টোটকায় সারেনি। ঝাড়গ্রামের হাসপাতালে ভর্তিও করা হয়েছিল। কিন্তু স্ত্রী খুকুমণির পক্ষে সংসার সামলে হাসপাতালে ছোটা সম্ভব ছিল না। তাই স্বামীকে বাড়িতে নিয়ে আসেন তিনি। গত রবিবার মৃত লেবু শবরের ছোট ছেলে প্রসেনজিতের বাঁ হাত ভেঙেছে। তাকেও কেউ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়নি। টাকা নেই বলে পল্টু শবরের দেহ জমির ধারে পুঁতে দিয়েছেন পরিজনেরা।

এ সবের জন্য অবশ্য শবরদের কথা শুনতে না-চাওয়ার মনোভাবকেই দায়ী করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। অসুস্থ হলে কাউকে কাউকে বুঝিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলেও বেশি দিন থাকেন না বলেই তাঁদের দাবি। আশাকর্মী রেখা মাহাতো, শম্পা সেন চৌধুরীরা বলেন, “ওঁরা সব সময় নেশায় ডুবে থাকেন। শিশুদের টিকা দিতে চান না। বলে, টিকা নিয়ে জ্বর হলে ওরা জঙ্গলে ডালপাতা কেমন করে সংগ্রহ করবে। বার বার বলা সত্ত্বেও বাড়িতেই ওদের সন্তান জন্মাচ্ছে।”

আরও পড়ুন: অন্ধকারেই শবররা, বিপদ মদের ভাটিতেই, মানছে শাসক

মেদিনীপুর লোধা-শবর কল্যাণ সমিতির সম্পাদক বলাইচন্দ্র নায়েকের কিন্তু অভিযোগ, প্রশাসনের তাগিদের অভাব আছে। তাই শবরদের দিনবদল হচ্ছে না। মদের ভাটি উচ্ছেদেও প্রশাসন উদাসীন।

এ দিন অবশ্য জেলা প্রশাসন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জঙ্গলখাসে। ঝাড়গ্রামের ডিএম আয়েষা রানি এসে মৃত লাল্টু শবরের কিশোরী মেয়ে সোনালি ও ছেলে মণীন্দ্রকে হোমে পাঠানোর নির্দেশ দেন তিনি। তাঁর দাবি, ‘‘শবররা সব সরকারি পরিষেবা পাচ্ছেন। আর সব মৃত্যুই সাম্প্রতিক নয়। অগস্ট থেকে পরপর কয়েক জন মারা গিয়েছেন।” স্বাস্থ্য দফতরের দলও এ দিন গ্রামে আসে। কয়েক ৈজনকে হাসপাতাল পাঠানো হয়। দুপুরে এসপি অমিতকুমার ভরত রাঠৌর এসে আশ্বাস দেন, “সমস্যা হলে জানান। আমরা পাশে আছি।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE