শুনানিতে আইনজীবীদের হাজির থাকতে হবে। নচেৎ আদালত একতরফা রায় ঘোষণা করবে বলে বৃহস্পতিবার তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। সেটা যে নিছক কথার কথা ছিল না, কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অসীম রায় শুক্রবার তা-ও বুঝিয়ে দিলেন।
এ দিন বিচারপতি রায় একটি মামলার রায় দিয়েছেন এক পক্ষের সওয়াল শুনেই। শুধু তা-ই নয়, মদন তামাঙ্গ হত্যায় আগাম জামিনের মামলার শুনানিতে অভিযুক্তদের কৌঁসুলিকে নিজের এজলাসে হাজির করিয়ে শুনানিতে যোগ দিতে বাধ্যও করেছেন। এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, শুধু মামলার নথি পড়ে ও সরকারপক্ষের সওয়াল শুনেই যদি মামলার নিষ্পত্তি হতে পারে, তা হলে আদালতে আদৌ আইনজীবীদের থাকার প্রয়োজন কী?
প্রসঙ্গত বিদেশে, বিশেষত মার্কিন মুলুকে বিচারপতিরা হামেশাই মামলার নথি দেখে নির্দেশ বা রায় দিয়ে থাকেন। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এখানকার আইনি মহলের বড় অংশ মনে করছে, এখানেও বিচারপতিরা এক বার এই পথে হাঁটতে শুরু করলে হুটহাট কর্মবিরতির প্রবণতার ভাটা পড়বে।
যেমন, কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় খোলাখুলিই বলেছেন, আইনজীবী না-থাকলে শুধু নথি দেখে বিচার করতে কোনও বাধা নেই। ‘‘কর্মবিরতির জন্য উকিল আসেননি। অথচ মক্কেলের জামিন-মামলা রয়েছে। তার ফয়সালা হবে না? সওয়াল না-হওয়ায় খুনের আসামির ফাঁসি হয়ে যাবে?’’— প্রশ্ন তাঁর। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপরাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ও বলছেন, ‘‘আইনজীবীরা আদালতে না-থাকলে বিচারপ্রক্রিয়া কি থমকে থাকবে নাকি? তা চালু রাখতে বিচারপতির নথি দেখে রায় দিতে বাধা নেই।’’ বম্বে হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় অবশ্য কিছুটা ভিন্নমত। তাঁর পর্যবেক্ষণ: ছোটখাটো মামলায় (যেমন মামলা আদৌ গৃহীত হবে কি না, কিংবা আগাম জামিন) নথি দেখে নির্দেশ বা রায় দেওয়া গেলেও ন্যায়-বিচারের প্রশ্নে তা সব সময় সম্ভব নয়। ‘‘নথিতে অনেক কিছু বলা থাকে না। আইনজীবীরা সেগুলো সওয়ালে বলেন। বিচারপ্রার্থীদের পক্ষে ওই সব নথি দাখিল করা কষ্টসাধ্য হতে পারে।’’— মন্তব্য চিত্ততোষবাবুর।
আইনজীবীদের কী অভিমত?
অধিকাংশই মুখ খোলেননি। যদিও কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘আইনজীবী হাজির না-থাকলে বিচারপতিরা শুধু নথি দেখে রায় বা নির্দেশ দিতেই পারেন।’’ তা হলে আইনজীবী-কর্মবিরতিতে কোর্ট অচল হয়ে থাকে কেন?
এক প্রবীণ আইনজীবী তথা কলকাতা হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সম্পাদকের ব্যাখ্যা, ‘‘সেটা বিচারপতিদের নিজস্ব ব্যাপার। তবে আইনজীবীদের সাহায্যে মামলার সওয়াল করাটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’ পাশাপাশি তিনি এ-ও বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা অনেক সময়ে কেস ডায়েরি পড়ে মামলার নিষ্পত্তি করে দেন। যাতে সময় বাঁচে, বিচারপ্রার্থীকেও অযথা হেনস্থা হতে হয় না।’’ কিন্তু সব ক্ষেত্রে এই দাওয়াই দিলে বিচারপ্রার্থীরাই সমস্যায় পড়বেন বলে কেউ কেউ সতর্ক করেছেন।
আইনজীবীর অনুপস্থিতিতে মামলা নিষ্পত্তির প্রসঙ্গটির সূত্রপাত বৃহস্পতিবার। বিচারপতি অসীম রায় সে দিন এজলাসে বসে জানিয়ে দেন, কর্মবিরতির সময় কোনও আইনজীবী মক্কেলের হয়ে মামলা দায়ের করে থাকলে কর্মবিরতি চলাকালীন মামলাটি যদি আদালতে ওঠে, আইনজীবী শুনানিতে যোগ দিতে বাধ্য। বিচারপতি শুধু বলেই থেমে থাকেননি। কোর্ট অফিসার ও অন্যান্য আইনজীবী মারফত গরহাজির আইনজীবীদের কাছে তিনি বার্তা পাঠিয়ে দেন, শুনানিতে না এলে আদালত একতরফা রায় দিয়ে দেবে।
কড়া বার্তায় কাজও হয়। বৃহস্পতিবার কর্মবিরতি সত্ত্বেও বিচারপতি রায়ের এজলাসে অনেক আইনজীবী উপস্থিত হন। ২৩টি মামলার নিষ্পত্তিও হয়ে যায়। শুক্রবার আরও এক ধাপ এগিয়ে বিচারপতি তাঁর অনড় অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন। কী রকম?
এ দিন ছিল বধূকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার এক মামলায় ননদের আগাম জামিন-আর্জির শুনানি। বিচারপতি রায় জানতে চান, বাদী-বিবাদী পক্ষের কৌঁসুলিরা হাজির রয়েছেন কি না। অভিযুক্তের কৌঁসুলির দেখা পাওয়া যায়নি। সরকারপক্ষের কৌঁসুলি সুদীপ ঘোষ আদালতকে বলেন, বিচারপতির বার্তা তিনি অভিযুক্তের কৌঁসুলি সুকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোবাইলে বৃহস্পতিবারই পাঠিয়ে দিয়েছেন। বিচারপতি কোর্ট অফিসারদের জিজ্ঞাসা করেন, আগাম জামিনের মামলাটি দায়ের হয়েছে কবে? জানা যায়, সেটি রুজু হয়েছে ১০ জুন,
অর্থাৎ যে দিন থেকে তিন দিনের কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বার অ্যাসোসিয়েশন। শুনে বিচারপতি রায় বলেন, তথ্যপ্রমাণ দেখে ও সরকারপক্ষের বক্তব্য শুনেই তিনি রায় ঘোষণা করবেন।
হয়ও তা-ই। সরকারপক্ষের কৌঁসুলি অভিযুক্তের আগাম জামিনের বিরোধিতা করেন। বিচারপতি মামলার তথ্য-প্রমাণ খুঁটিয়ে দেখে আগাম জামিনের আবেদন খারিজ করে দেন। এর পরে তালিকাভুক্ত ছ’টি আগাম জামিনের মামলার উল্লেখ করে বিচারপতি জানতে চান, বাদীপক্ষের আইনজীবী কে?
জানা যায়, মদন তামাঙ্গ হত্যায় অভিযুক্ত বিমল গুরুঙ্গ-সহ ২৩ জনের তরফে দায়ের ওই সব মামলার আইনজীবীর নাম সায়ন দে। বিচারপতি রায় নির্দেশ দেন, ওঁকে বেলা দু’টোয় তাঁর এজলাসে হাজির হতে হবে। খবর পেয়ে নির্ধারিত সময়ে সায়নবাবু আসেন। বিচারপতি রায় তাঁর কাছে মামলা দাখিলের তারিখগুলি জানতে চান। সায়নবাবুর দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, সুষমা রাই-সহ ১১ অভিযুক্তের আগাম জামিনের মামলাটি দাখিল হয়েছে ১০ জুন সকালে।
মানে, কর্মবিরতি চলাকালীন। বিচারপতি রায় হুঁশিয়ারি দেন, ১০ তারিখে যে মামলা দায়ের করার সময় দ্রুত শুনানি চেয়ে আলাদা আবেদনও করা হয়েছিল, তার শুনানি এ দিন না-হলে দু’মাসের জন্য সেটি পিছিয়ে দেবেন। সায়নবাবু জানান, মামলাটিতে প্রবীণ আইনজীবী শেখর বসুর সওয়াল করার কথা রয়েছে। বিচারপতি তাতেও শুনানি স্থগিত রাখতে রাজি হননি।
অগত্যা সায়নবাবুই সওয়াল করেন। ২০ মিনিট শুনানির পরে বিচারপতি রায় জানিয়ে দেন, পরবর্তী শুনানি হবে আগামী সোমবার। কর্মবিরতি কাটিয়ে আইনজীবীরা ফের কাজে যোগ দেবেন কি না, সে দিনই অ্যাসোসিয়েশনের তরফে তা স্থির হওয়ার কথা।
কড়া দাওয়াইয়ে বিচারের গতি কতটা মসৃণ হয়, সেটাই এখন দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy