প্রতীকী ছবি।
বৃষ্টির বিড়ম্বনা এই সবে বন্ধ হয়েছে। কিন্তু ডিজ়েল-সহ জ্বালানির দামের ক্রমবৃদ্ধিতে ছেদ নেই। এই জোড়া বিপত্তির প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়ায় আনাজ বাজারের আগুন লেলিহান।
বর্ষা থেকে এই হেমম্ত পর্যন্ত দফায় দফায় অতিবৃষ্টি বিঘের পর বিঘে জমির আনাজে ‘আগুন’ লাগিয়ে দিয়েছিল। তাতে ইন্ধন জুগিয়ে অনেক জায়গায় একশো টাকা পেরিয়েছে লিটার-পিছু ডিজ়েলের দাম। অতিবর্ষণে ফলন নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আনাজের জোগান কম। যেটুকু যা পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলিকে বাজার পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার পরিবহণ ব্যয় রোজই বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুমূল্য জ্বালানি। উৎসবের মরসুমে পাহাড় থেকে সাগর পর্যন্ত কাঁচা আনাজের বাজারে তাই এখন ত্রাহি ত্রাহি রব।
প্রকৃতির মর্জি আর পেট্রোপণ্যের অপ্রতিহত মূল্যবৃদ্ধির যুগলবন্দিতে কয়েক দিনে এক ধাক্কায় আনাজের দাম প্রতি কিলোগ্রামে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়ে গিয়েছে রাজ্যের প্রায় সব বাজারে। পুজোর সময় বাজারদর প্রতি বারেই কিছুটা বাড়ে। কিন্তু এ বার পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম অবস্থা আমজনতার। কেউ রান্নার পদ কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তো কেউ কমিয়ে দিচ্ছেন কেনাকাটার পরিমাণ।
এই সময়ে আনাজের দাম বাড়ার আরও একটা কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা দায়ী করছেন পুজোর চাঁদাকেও। ওয়েস্ট বেঙ্গল চাষি ভেন্ডার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কমল দে জানান, এমনিতেই প্রতি বছর কালীপুজোর আগে আনাজের দাম বাড়ে। জেলা থেকে আনাজের গাড়ি আসার পথে কালীপুজোর চাঁদা দিতে এক-একটি গাড়ির সব মিলিয়ে দুই থেকে তিন হাজার টাকা খরচ হয়। কখনও অনেক পুজোর চাঁদা দিতে গিয়ে এক-একটি গাড়ির সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার টাকা বেরিয়ে যায়। কমলবাবু বলেন, “কালীপুজোয় চাঁদার জুলুম প্রায় প্রতি বছরই থাকে। তার সঙ্গে এ বার যুক্ত হয়েছে পেট্রল, ডিজ়েলের দাম। ওই দুই জ্বালানির বেলাগাম দামের জন্য গাড়ির ভাড়া অনেক বেড়ে গিয়েছে। কোলে মার্কেটে এমনিতে প্রতিদিন যত আনাজের গাড়ি আসে, এখন তার থেকে আসছে অনেক কম।’’
কোলে মার্কেটের পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীদের মতে, পাইকারি আনাজের দামের সঙ্গে কলকাতার বিভিন্ন খোলা বাজারের আনাজের দামের তফাত ২০ থেকে ২৫ টাকা হয়ে যাচ্ছে। এটা কোনও ভাবেই কাম্য নয়। পাইকারি বাজারের সঙ্গে খোলা বাজারের দামের পার্থক্য বড়জোর ১০-১২ টাকা হতে পারে।
গড়িয়াহাট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপকুমার মণ্ডল বলছেন, “এমনিতেই আনাজ কম আসছে। তার উপরে শিয়ালদহ কোলে মার্কেটে থেকে গড়িয়াহাট বাজারে এক গাড়ি আনাজ আসতে যেখানে ৪০০ টাকা লাগত, ডিজ়েলের দাম বাড়ায় এখন লাগছে ৬০০ টাকা।” মানিকতলা বাজারের আনাজ বিক্রেতা পিন্টু দাস জানান, কলকাতার আশপাশের পাইকারি বাজারে চাষিরা কম আনাজ আনছেন। স্টোরের আনাজ কিনতে হচ্ছে। ফলে পাইকারি ক্ষেত্রেও বেশি দাম দিতে হচ্ছে।
দুই ২৪ পরগনার বিভিন্ন বাজারে দুর্গাপুজোর আগে বেগুন, পটল, শিম, ফুলকপি, আলু, ঝিঙের যা দাম ছিল, তার থেকে কেজিতে ১০-১৫ টাকা বেড়েছে। চাষের জমিতে জল জমে মাঠেই নষ্ট হয়েছে বহু আনাজ। হুগলির বিভিন্ন বাজারে পটল, উচ্ছে, ঝিঙে, ঢেঁড়সও এখন বহুমূল্য। কেজি প্রতি ১০-২০ টাকা দাম বেড়েছে গত কয়েক দিনে। হাওড়া গ্রামীণ এলাকায় বেগুন ৭০-৮০ টাকা, পেঁয়াজ ৪০-৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
আনাজের দাম আকাশছোঁয়া উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন বাজারেও। আলিপুরদুয়ার থেকে মালদহ, উত্তর দিনাজপুর, জলপাইগুড়ির বাজারে রবি মরসুমের আনাজ গত বছরের তুলনায় বিক্রি হচ্ছে অন্তত ২০-৩০ টাকা
বেশি দরে। ব্যবসায়ীরা জানান, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের প্রবল বৃষ্টিতে খেত ডুবে নষ্ট হয়েছে রবিশস্যের চাষ। পালং শাক বিকোচ্ছে ১০০ টাকা কেজিতে। বীরভূমে এক টোম্যাটোর কেজি ৬০ টাকা, বেগুন ৭০ টাকা, করলা ১২০ টাকা। ধনেপাতা ৩০০ টাকা, শসা ৪০ টাকা কেজি। সেখানকার আনাজ বিক্রেতা নেকরাউল শেখ বলেন, ‘‘ডিজ়েলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভিন্ জেলা থেকে আনাজ আনতে বেশি খরচ হচ্ছে। এলাকায় আনাজ ওঠার আগে দাম কমার সম্ভাবনা কম।’’
পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুরের সেন মার্কেটের ব্যবসায়ী সাগর সাহা বলেন, “অতিবৃষ্টিতে আনাজ সরবরাহ কমেছে। ডিজ়েলের দাম বাড়ায় গাড়ি-ভাড়া বেড়েছে। তাই আনাজের দাম ঊর্ধ্বমুখী।” পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলীর আড়তদারদের ব্যাখ্যা, চাহিদার তুলনায় আনাজের জোগান অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। বার বার বৃষ্টি, জমিতে জল জমে যাওয়া এবং তার জেরে গোড়াপচা রোগেই এই অবস্থা।
লক্ষ্মীপুজোর পরে আনাজের দাম চড়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন বাজারেও। একই হাল মুর্শিদাবাদের। সেখানকার ডিস্ট্রিক্ট চেম্বার অব কমার্সের যুগ্ম সম্পাদক স্বপনকুমার ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘পেট্রোপণ্যের দাম বাড়ায় উৎপাদনের খরচ বেড়েছে। তাই দাম বাড়ছে সব কিছুরই।’’
ভেন্ডার সমিতির প্রধান কমলবাবুর বিশ্বাস, কালীপুজোর পরে আনাজের দাম কমবে। শীতের আনাজপাতিও আসতে শুরু করবে আরও বেশি করে। প্রশ্ন উঠছে, রাজ্য জুড়ে তত দিনে তো ক্রেতাদের নাভিশ্বাস উঠে যাবে। আশু সুরাহার উপায় কী?
উত্তর আপাতত অধরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy