কাকলি ও সখিনা। হরিহরপাড়ার চোঁয়া গ্রামে। নিজস্ব চিত্র
পুজোর দিনেও শয়তানের কথাই মনে পড়ে।
শয়তান যে মানুষের শিরায়-রক্তে থাকে, তা কী জানত না কাকলি! সখিনার কাছে শয়তান আজাজিল আর সৃষ্টিকর্তার গল্প তবু হাঁ করে শোনে মেয়েটা। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দিলে হিংসায় জ্বলেপুড়ে বদলা নিয়েছিল শয়তান। সেই থেকে মানুষের রক্তে সে মিশে!
নিকষ রাত নামলে তাই সখিনার কোলের মেয়েটাকে আঁকড়ে ধরে কাকলি। বাবা লোকনাথ, মা কালী, দুগ্গা আর গোপাল ঠাকুরের নাম নিয়ে সখিনার শয়তান তাড়ানোর দোয়ার মন্ত্রটাও বিড়বিড় করে দু’বার। শুনে শুনে মুখস্থ কাকলির, আউজু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম,
বিসমিল্লাহি রাহমানের রাহিম মন্ত্রের জোরে শয়তান নাকি ৪০ হাত দূরে ছিটকে পড়বে। কোনও দিন সখিনাও বলে, অসুর-বধের গল্প শোনাবি! হরিহরপাড়ার চোঁয়া গ্রামে টিন-ঘেরা ঘরে দুই সখী মুখ চেপে হেসে ওঠে, আমাদের বর-অসুর! সেই যে পাশের কর্মকার-বাড়ির গঙ্গা কাকিমা, রাবিয়া ভাবিরা চোখ মুছতে মুছতে বলেছিল, মেয়েদের জীবন তো অসুরেরই সংসার।
অসুরের সঙ্গে যুদ্ধের দিন-রাত্রি!
মুখচোরা বাপের অপমান ফালা-ফালা করে দেয় কাকলিকে। গ্রামের যজমান দে, সরকারদের ঘরের বিপত্তারিণী, ‘বারে’র পুজো বন্ধ প্রায় দশ মাস। ট্যাংরামারিতে শ্রাদ্ধের কাজে ডেকে এনে মুখের উপরে বলল, মাফ করবেন ঠাকুরমশাই, শেষটা মুসলমানের মেয়েকে ঘরে আশ্রয় দিলেন। বাবা নিঃশব্দে উঠে আসেন।
কাঁচা ঘরে ঠাকুরের আসন পাতার ঠাঁই নেই। ছেঁড়াখোড়া পুরোহিত-দর্পণ, দুর্গাপূজা-পদ্ধতির পাতা ওড়ে। চরমোক্তারপুরে দুর্গাপুজোর বাঁধা যজমানের সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরেছে। তবে জগন্নাথপুরের চাঙাবাঁধে একটা পুজো ধরেছেন সুভাষ রায়চৌধুরী। পুজোয় তো কোনও বারই ঘরে থাকতে পারে না মানুষটা। স্ত্রী ইলা বলেন, ‘‘হ্যাঁ গো, ঘরে লাইট, ফ্যান, মশারি দিবা তো তোমায়? মুখ ফুটে বল না কিছুই।’’
মনে পড়ে কত বছর আগের সেই পুজো! মেয়ে কাকলির বর এসেছিল, গুঁড়ো দুধের টিন নিয়ে। ওর ছেলেটা তখন সবে হয়েছে। তারপর আর ফিরেও চায়নি। সেই ছেলে বাবান এ বার মাধ্যমিকে পাশ দিয়েছে। ইলা ভাবেন, শ্বশুরঘরে অসুরের সঙ্গে যুদ্ধে আমার মেয়েটা তো মার খেয়ে মরেনি। মেয়ে আমার বুকে আছে। মোটা ভাতকাপড়ে বাঁচুক, তবু তো আছে। শ্বশুরবাড়িতে নগদ-গয়না সব খোয়ালেও সম্মান খোয়াতে দেননি কাকলির মা।
অসুরের সঙ্গে যুদ্ধের মর্ম তাই তো বোঝে মেয়েটা। গেল পৌষের এক সকালে দাওয়ার বাইরে গাছতলায় এক মাসের মেয়ে কোলে কাঁচা শরীরে কাঁপছিল সখিনা। বরের মার খেয়ে রক্ত ঝরছিল কষ বেয়ে। পাশে বড় ছেলে দশ বছরের সূর্য শেখ। বাবাকে ডেকে কাকলি বলে, “আমারই মতো অসহায় ও! ওকে কি একটু ঠাঁই দিবা বাবা?”
সুভাষবাবু বলেন, “সখিনা কি আমার মেয়ে নয়? যন্ত্রণার হিন্দু-মুসলমান হয় কি!”
আম-কাঁঠালের দাওয়ায় কাঁচাঘরের সংসারে তাই রাতারাতি তিনটে প্রাণীর সংযোজন! সুভাষ, ইলা, কাকলি, কাকলির দাদা সুকান্ত, কাকলির পুত্রের সঙ্গে সখিনা, তার ছেলে ও মেয়ে। “আমি তো জানতাম গাছতলাতেই মরব! সোয়ামি তালাক ছাড়াই বাচ্চা দুটো সুদ্ধ ঘর থেকে মেরে বের করে দিল। কাকু-কাকিমা আমার ফেরেস্তা হয়ে এসেছেন।”
যন্ত্রণার ঐক্যই মিলিয়েছে সখিনা-কাকলিকে। কাকলির তা-ও বাপের বাড়ি রয়েছে। পদ্মাপারের দেশ জলঙ্গিতে সখিনার মা যত দিন ছিল, জামাই নুর ইসলামের টাকার দাবি যে ভাবে হোক মেনে নিত। সেই টাকাতেই ঘর তুলেছিল নতুন। রাজমিস্ত্রি জামাই কয়েক মাস অন্তর গ্রামে ফিরে বৌ পিটিয়েই বীরত্ব দেখাত। ফোন করে সখিনা কাঁদলে দাদারা বলত, তুই এলে আয়। ফের বিয়ে দেব, কিন্তু বাচ্চাদের রাখতে পারব না। কোনও মা কি পারে তা, কখনও?
কাকু-কাকিমার মাঝে বসে সখিনা বলে, ‘‘আমায় আশ্রয় দেওয়ার জন্য করিমপুরে কাকিমার বাবার বাড়ি থেকে আর কেউ আসে না, এখানে!’’ “না-আসুক, তুই কি আমার মেয়ে নোস, তোর কান্না আমি দেখতে পারব না।”— কথা কেড়ে বলেন কাকিমা।
কাছের পড়শিদের সঙ্গে সম্পর্ক পাল্টে গিয়েছে রাতারাতি। সখিনাকে নিয়ে গুজগুজ-ফুসফুস! সামান্য রোজগেরে কাকলির দাদা সুকান্তের বিয়ে আটকে বাড়তি ঘরের অভাবে। হাসি মুখে ‘দুই বোন’কে ঘর ছেড়ে সে দাওয়ায় ঘুমোয়, আজ কত দিন।
গরিব ব্রাহ্মণ ঘরেই মাসভর রোজা, নমাজ রাখে ভিনধর্মী মেয়ে। সেহ্রির সময়ে কাকভোরে উঠে কাকিমা তাঁর মুসলিম মেয়ের ভাত রেঁধে দেন। সাঁঝে প্রিয় সখীর মিছরির সরবত, খেজুর, আপেল এগিয়ে দেয় কাকলি। কদাচি়ৎ মাংস হলে সখিনার আবদার, আমি রাঁধি ওটা। কুড়িয়ে পাওয়া মুক্তোর মতো মেয়ের জন্য ইদে সিমুই রাঁধেন কাকিমা।
পিচরাস্তার ধারে কাকলির অলিভিয়া লেডিজ় পার্লারে মহালয়ার পরে মেয়েদের ভিড়। সখিনাও তার সঙ্গী। কাকলি বলে, ‘‘পাকা বুড়িটা, ওর হাতে সামান্য ক’টা টাকা দিতেই আমার ছেলেটাকে জামা দিয়েছে!’’ সখিনা বলে, ‘‘আর কী পারি বল! আমার টাকা, গয়না, বাড়ি সব তো শয়তানটা কেড়ে নিয়েছে। কিছুই করল না পুলিশ।’’
চোঁয়া গ্রামের ভাঙা ঘরে চুঁইয়ে পড়ে দূরের ভালবাসা। বাগুইআটি, খড়্গপুর থেকে পুজো উদ্বোধনের চিঠি আসে ‘মনুষ্যধার্মিকেষু’ সুভাষবাবুর। কাকলির দেওয়া ইদের জুতোয় সেজে পুজোর ছুটিতে দেদার ক্যাপ ফাটায় সখিনার ছেলে। দুই মেয়ে, খুদেদের কলকলানিতে ঠিক হয় সবাই মিলে টোটোয় হরিহরপাড়া যাওয়া হবে পুজোয়। ইলা বলেন, ‘‘বিডিও সাহেবকেও বলেছি, আমার মেয়ে সখিনার নিরাপদ ঘর হওয়া ইস্তক ওর হাত ছাড়ব না আমরা।’’
মুর্শিদাবাদের অখ্যাত উঠোন থেকে অসুরের চোখে চোখ রাখে চিরন্তন ভারতবর্ষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy