পাড়ুই-হত্যার তদন্তে গঠিত বিশেষ দল (স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম, সংক্ষেপে সিট) কেন কলকাতা হাইকোর্টকে না-জানিয়ে নিম্ন আদালতে মামলার চার্জশিট জমা দিল, আদালত তার ব্যাখ্যা চেয়েছে। এবং আজ, বৃহস্পতিবার বিচারপতি হরিশ টন্ডনের এজলাসে এসে সেই ব্যাখ্যা পেশ করার কথা খোদ রাজ্য পুলিশের ডিজি’র, হাইকোর্টই যাঁকে সিটের মাথায় বসিয়েছে।
১৯ অগস্ট বিচারপতি টন্ডনের ‘ডিজি-তলবের’ নির্দেশকে বুধবার বিকেল পর্যন্ত রাজ্য সরকারের তরফে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। হাইকোর্ট-সূত্রের খবর, আজ সকালেও যদি নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করা না-হয়, তা হলে ডিজি-কে আদালতে হাজির হতেই হবে। আর সে ক্ষেত্রে ডিজি জিএম প্রভু রাজাশেখর রেড্ডি বিচারপতিকে কী ব্যাখ্যা দেন, তা নিয়ে আইনজীবী মহলে যথেষ্ট কৌতূহল দানা বেঁধেছে।
প্রসঙ্গত, এর আগে পাড়ুই-মামলায় হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তও ডিজি’কে এজলাসে তলব করেছিলেন। কিন্তু হাজিরার দিনই সরকার হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করে নির্দেশে স্থগিতাদেশ পেয়ে গিয়েছিল। সেই মামলাই পরে সুপ্রিম কোর্ট-হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির এজলাস-বিচারপতি দত্তের এজলাস ঘুরে এসেছে বিচারপতি টন্ডনের হাতে। বিচারপতি টন্ডনও সিট-তদন্তের রকম-সকম দেখে অসন্তুষ্ট হয়ে ডিজি-কে তলব করেছেন। তাঁর নির্দেশের পরে ১৫ দিন সময় পেলেও রাজ্য সরকার এখনও তা চ্যালেঞ্জ না-করায় হাইকোর্টের আইনজীবীদের কেউ কেউ মনে করছেন, সরকার আর ওই পথে হাঁটবে না। এ হেন অভিমতের কারণ কী?
ওঁদের যুক্তি: বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের নির্দেশে কিছু ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য থাকায় রাজ্য সেই অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। কিন্তু বিচারপতি টন্ডনের নির্দেশে বিতর্কিত কিছু নেই। বরং নির্দেশটি খুবই সরল। “হাইকোর্টই সিট গড়ে দিয়েছে। হাইকোর্টেরই তত্ত্বাবধানে তদন্ত চলছে। অথচ নিম্ন আদালতে চার্জশিট পেশ করার আগে সিট কেন হাইকোর্টের অনুমোদন নিল না, সেই স্বাভাবিক ও সহজ প্রশ্নটাই তুলে ধরেছে আদালত।” মন্তব্য এক আইনজীবীর। বস্তুত ওঁদের একটা বড় অংশের মতে, প্রশ্নটি যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। তাই সরকারের পক্ষে নির্দেশটি চ্যালেঞ্জ করা কঠিন।
২০১৩-র ২১ জুলাই, অর্থাৎ চতুর্থ দফার পঞ্চায়েত ভোটের আগের রাতে পাড়ুইয়ের কসবা গ্রামের বাঁধ নবগ্রামে খুন হন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলকর্মী সাগর ঘোষ, যাঁর ছেলে হৃদয় ঘোষ নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। পুত্রবধূ শিবানীদেবীর অভিযোগ ছিল, গুলিবিদ্ধ সাগরবাবুকে ফেলে রেখে পুলিশ জবরদস্তি পরিবারকে দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়েছে, এবং তাতে ক’জনের নাম লিখে তাদের গ্রেফতার করে আসল অপরাধীদের আড়াল করেছে। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে পুলিশ সাগর-হত্যার এফআইআর নেয়, যাতে তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের পাশাপাশি বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীরও নাম আছে। এ দিকে ধৃতেরা জামিন পেয়ে ঘটনার সিবিআই-তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে মামলা করেন। পরে সাগরবাবুর পরিবার তাতে সামিল হয়। কোর্টের কাছে পরিজনদের দেওয়া জবানবন্দিতেও অভিযুক্ত-তালিকায় অনুব্রতের নাম এক নম্বরে।
বীরভূম জেলা পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলে সাগরবাবুর ছেলে হৃদয়বাবুর দায়ের করা মামলা হাইকোর্টে প্রথমে উঠেছিল বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের আদালতে। হৃদয়বাবুর অভিযোগ ছিল, অনুব্রত-বিকাশকে গ্রেফতার তো দূর, পুলিশ তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করেনি! এমতাবস্থায় বিচারপতি দত্ত গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পাড়ুই-তদন্তে বিশেষ দল (সিট) গড়ে দিয়ে ডিজি’কে মূল তদন্তকারী নিযুক্ত করেন। তদন্তের প্রথম অগ্রগতি-রিপোর্ট হাইকোর্টকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সিটের পরবর্তী রিপোর্টও কোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিচারপতি টন্ডনও সিট-তদন্তের গতি-প্রকৃতিতে খুশি হতে পারেননি। তিনিও প্রশ্ন তুলেছেন, সিটের চার্জশিটে কেন অনুব্রত-বিকাশের নাম নেই? কেনই বা ওঁদের গ্রেফতার করা হল না? “সিট আরও সক্রিয় হয়ে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে পারত। তা করেনি।” রিপোর্ট পড়ে মন্তব্যও করেছেন তিনি। আইনজীবীদের একাংশের ধারণা, আজ ডিজি যদি হাইকোর্টে হাজির হন, তাঁকে এই সব প্রশ্নের মুখোমুখি পড়তে হবে।
আর সিটের প্রধান তখন কী ব্যাখ্যা দেন, তা শুনতে উৎসুক রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তাদেরও অনেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy