ছত্রধর মাহাতো। নিজস্ব চিত্র।
মাস পাঁচেক আগেও ছিলেন জেলে। দীর্ঘ ১১ বছর কারাবাসের অবসান ঘটে গত ফেব্রুয়ারি মাসে, রাজ্য সরকারের তৎপরতাতেই। বীজ বপনের কাজ চলছিল তখন। অবশেষে ফল দেখা গেল। একদা ‘শত্রু’ ছত্রধর মাহাতো তৃণমূলের সাংগঠনিক রদবদলের পরে দলের অতি প্রভাবশালী রাজ্য কমিটিতে জায়গা পেলেন। ‘বহিরাগত’ হলেও জঙ্গল মহলে জমি পুনরুদ্ধারে এলাকার এই প্রাচীন যোদ্ধার উপরেই ভরসা রাখতে চাইছে তৃণমূল। আর কৃতজ্ঞ ছত্রধর মাহাতো আনন্দবাজার ডিজিটালকে বুঝিয়ে দিলেন, জঙ্গলমহলের রুক্ষ, বিমুখ জমিতে ঘাসফুল চাষের যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন তিনি।
মাওবাদী সংগঠনের পলিটবুরো সদস্য কিষেনজির মস্তিষ্কপ্রসূত লালগড় আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জঙ্গলমহলের ‘পোস্টারবয়’। সেই লালগড় অন্দোলনের ‘মুখ’ ছত্রধর মাহাতোকে সামনে রেখেই কি একুশের বিধানসভা নির্বাচনে জঙ্গলমহলের হারানো জমি ফিরে পাওয়ার পরিকল্পনা করছেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? ইঙ্গিতটা আগেই ছিল, জঙ্গলমহলের রাজনীতিতে ছত্রধরকে সামনে রেখে এগোতে চায় তৃণমূল। মাওবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত ছত্রধরকে ২০১৮ সাল থেকে জেলমুক্ত করার ব্যাপারে রাজ্য সরকারের মনোভাবেই তার ইঙ্গিত ছিল। তবে বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলের সাংগঠনিক রদবদলে বৃহস্পতিবার তাঁকে রাজ্য কমিটির অন্তভুক্ত করার পর সেই ইঙ্গিত অনেকটাই জোরালো হল। আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে দলের সাংগঠনিক রদবদলের পর যে রাজ্য কমিটি গঠন করা হয়েছে তাতে ছত্রধর মাহাতোকে অন্যতম সচিব হিসাবে অন্তভুক্ত করা হয়েছে।
যদিও রাজ্য কমিটির সচিব পদে মমতা তাঁকে মনোনীত করবেন তা ভাবেননি ছত্রধর। বরং তাঁর অনুগামীদের আশা ছিল, ঝাড়গ্রাম জেলার সভাপতি বা সাংগঠনিক কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদ পাবেন তিনি। বৃহস্পতিবার বিকেলে ছত্রধরকে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘‘জেলার দায়িত্ব পেলে খুব ভাল হত। কারণ, এখানকার মানুষ চাইছেন। এখানকার ব্লক স্তরের নেতৃত্ব বা অঞ্চল স্তরের নেতৃত্বও চাইছেন। অনেকে তো আশা করে। তবে পার্টি যে দায়িত্ব দেবে সেটাই তো নিতে হবে মাথা পেতে।” ছত্রধর জানিয়েছেন, তৃণমূল ভবনে সম্মেলন চলাকালীনই দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় ফোন করে জানান যে, তাঁকে রাজ্য কমিটির অন্তভুক্ত করেছেন সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছত্রধর আরও বলেন, ‘‘তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে আমি তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী। ২০০৮ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। জঙ্গলমহল আমাকে পরিচয় দিয়েছে। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে জঙ্গলমহলের মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে সেটাই আমার বড় প্রাপ্তি।” তবে তাঁর দাবি, সচিব হিসাবে তাঁর কী ভূমিকা তা এখনও তিনি জানেন না। এখনও তাঁকে কিছু বলা হয়নি সচিব হিসাবে কোন দায়িত্ব সামলাতে হবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ছত্রধর মাহাতো, ২০০৯ সালে জঙ্গল মহলে। ফাইল চিত্র।
ঝাড়গ্রাম জেলা তৃণমূলের যে অংশটি ছত্রধর অনুগামী বলে পরিচিত তাঁদের এক জনের কথায়, ‘‘দাদাকে জেলার সংগঠনের দায়িত্ব দেওয়া হবে, এমনটাই আশা করেছিলাম। কারণ, দলকে ঘুরে দাঁড়াতে জেলা সংগঠনে অনেক রদবদল দরকার। সেটা হল না।” হতাশার ছাপ ওই ছত্রধর অনুগামীর গলায়। যদিও তৃণমূলের অন্য একটি অংশের দাবি, বিনপুর-১ এলাকার কর্মীদের একটা অংশ ছত্রধরের অনুগত হলেও, জেলার বাকি অংশে ছত্রধরের সেই প্রভাব নেই। তাই তাঁকে জেলা সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হলে জেলার কর্মীদের মধ্যে বিরূপ মনোভাব তৈরি হত। সে ক্ষেত্রে নয়াগ্রামের বিধায়ক দুলাল মূর্মূকে জেলা সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত। তাঁদের ইঙ্গিত, নির্বাচনের সময় ছত্রধরকে জঙ্গলমহলে প্রচারে ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু এখনই সাংগঠনিক দায়িত্বে আনলে তা এত দিন ধরে জেলায় যাঁরা সংগঠন সামলেছেন তাঁদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হত।
আরও পড়ুন: নজরে ২০২১, তৃণমূলে ব্যাপক রদবদল, ঘর গোছালেন মমতা
২০০৯ সালের ২৭ অক্টোবর পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনগণের কমিটির সশস্ত্র সদস্যেরা ছত্রধর মাহাতোর মুক্তির দাবিতে ঝাড়গ্রামের বাঁশতলায় পণবন্দি করেছিল রাজধানী এক্সপ্রেস। ছত্রধর ওই কমিটিরই মুখপত্র ছিলেন। ওই ঘটনার তদন্ত করছে এনআইএ। ছত্রধরকে এ দিন এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমার তো মনে হয় এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।” জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ ২০০৯ সালের লালগড় থানার আরও একটি মামলার তদন্ত শুরু করেছে— প্রবীর মাহাতো-সহ দু’জন সিপিএম কর্মীর খুনের ঘটনা। প্রায় ৩০ জন সশস্ত্র মাওবাদী মিলিশিয়া খুন করে ওই দুই সিপিএম কর্মীকে। তৃণমূলের পশ্চিম মেদিনীপুরের এক নেতার কথায়, ‘‘দিদি চাইলেও, ছত্রধরের অতীত তাঁর পিছু ছাড়বে না। এলাকার কেউ ভুলে যাননি যে, ছত্রধরই ছিলেন লালগড় আন্দোলনে মাওবাদীদের হাতে নিয়ন্ত্রিত কমিটির মূল মাথা।”
আরও পড়ুন: লকডাউনে সুনসান শহর, রাতভর শিলিগুড়ির রাস্তায় টহল দিল হাতির দল
এক সময়ে ছত্রধরের মুক্তির দাবিতে এপিডিআরের মতো মানবাধিকার সংগঠন সরব হয়েছিল। সেই সংগঠনেরই অন্যতম সদস্য রঞ্জিত শূর বলেন, ‘‘জেলমুক্ত হয়ে ছত্রধর রাজনীতি করবেন কি না সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে তিনি ছিলেন এ রাজ্যের রাজনৈতিক বন্দিদের আইকন। তাঁর মনে রাখা উচিত যে, এখনও এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলে বন্দি হয়ে রয়েছেন ৭৫ জনেরও বেশি রাজনৈতিক বন্দি। তাঁদের মধ্যে ৫০ জনই জঙ্গলমহলের বাসিন্দা। এঁদের একটা বড় অংশই তাঁর সঙ্গে লালগড় আন্দোলনে সামিল হয়ে জেলবন্দি। আমরা আশা করব তাঁদের মুক্তির ব্যাপারে, বিশেষত জঙ্গলমহলের জেলবন্দি মানুষের মুক্তির ব্যাপারে তিনি তৎপর হবেন।”
তবে ছত্রধর এ দিন জানান, তাঁর এই রাজনীতির দ্বিতীয় ইনিংসে বিজেপিকে হঠানোই মূল লক্ষ্য। গত দু’বছরে জঙ্গলমহলে জনজাতিদের অরাজনৈতিক সংগঠনের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘‘ওটা সামলে নেব।”
জঙ্গলমহল তাঁকে রাজনৈতিক পরিচয় দিয়েছে। জঙ্গলমহলের আন্দোলনের ‘মুখ’ ছত্রধর মাহাতো। অতীত জয় করে বর্তমানের পরিচয়ে এগনোই বোধহয় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৃণমূলের রাজ্য কমিটির সদস্য ছত্রধর মাহাতোর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy