Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

নেতা দিলীপের জমি কাড়তে মরিয়া ‘বেটা’, মন কাড়়ছেন চিত্তও

খড়গপুর পুরসভার চেয়ারম্যান প্রদীপই এ বার চাকা ঘোরানোর জন্য শাসক দলের বাজি।

 —ফাইল চিত্র

—ফাইল চিত্র

সন্দীপন চক্রবর্তী
খড়গপুর শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৯ ০১:৪৬
Share: Save:

ল্যাম্পপোস্ট, বাসের গা, টোটোর পিছন,মায় আধভাঙা পাঁচিলটুকু পর্যন্ত ফাঁকা নেই! ফুটবল আকৃতির বেলুন রাতের আকাশে যে আলো ছড়াচ্ছে, সেখানেও তিনি। নানা মাপের কাট-আউট তো অজস্র। হয় ‘নেতা নেহি, বেটা হ্যায়’, নয়তো ‘জনসেবক’ রূপে তিনি সর্বত্র বিরাজমান।

প্রয়াত জ্ঞানসিংহ সোহনপালকে (চাচা) নীরবে জনসেবার কাজে বছরের পর বছর দেখতে অভ্যস্ত রেল-শহরে ‘জনসেবক’-এর এমন উচ্চকিত প্রচার চোখ ধাঁধিয়ে দিতে বাধ্য!প্রচারের রকম-সকম দেখে তৃণমূলের অধুনা উপদেষ্টা প্রশান্ত কিশোরের সংস্থার ছাপ বেশ পড়ে ফেলা যাচ্ছে। ঢোল-তাসা নিয়ে ট্যাবলো, টোটোও ঘুরছে। সে সব দেখতে দেখতে গোলবাজারের দলীয় কার্যালয়ে পৌঁছলে দেবনাগরী হরফে বাংলায় লেখা ‘প্রদীপের পঞ্চ প্রতিজ্ঞা’ আর এক প্রস্ত চোখ টানছে! প্রায় নিশুতি রাতেও সে দফতরের আনাচে-কানাচে অন্তত দু’শো মুখ। রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা সেখানেই।

এ তো এলাহি ব্যাপার! ‘পঞ্চ প্রতিজ্ঞা’র প্রদীপ সরকার হেসে বলছেন, ‘‘আমার সাউথ ইন্ডিয়ান স্টাইল। কাউন্সিলরের ভোট হোক আর যা-ই হোক, আমি এ ভাবেই ভোটটা করি।’’ খড়গপুর পুরসভার চেয়ারম্যান প্রদীপই এ বার চাকা ঘোরানোর জন্য শাসক দলের বাজি। উত্তরবঙ্গের কালিয়াগঞ্জের মতো দক্ষিণের এই খড়গপুর বাংলার সেই বিরল বিধানসভা কেন্দ্র, যেখানে তৃণমূল কখনও জয়ের মুখ দেখেনি। ‘পরিবর্তন’ আনতে তাঁর অস্ত্র কী? প্রদীপের চটজলদি জবাব, ‘‘খড়গপুর চিরকাল প্রার্থী দেখে ভোট দেয়, পার্টি নয়। চাচা ছিলেন, এখন আমি আছি। শহরের উন্নয়নের জন্য আমার কাজই আমার অস্ত্র।’’

‘‘পরিবর্তন মানে কি শুধু এমএলএ-এমপি বদলানো? পরিস্থিতির পরিবর্তন চাই। সেই পরিবর্তনের জন্যই বাংলায় বিজেপি লড়াই করছে। আর উন্নয়নের নামে পুলিশ-মাফিয়া দিয়ে তৃণমূল এখানে কী করেছে, সবাই জানে।’’ রামমন্দিরের সামনে রোড-শো শেষ করে পাল্টা বলছেন প্রেমচন্দ্র ঝা। তৃণমূলকে ‘মাফিয়া’-তিরে বিঁধছেন যিনি, তাঁর ভাবমূর্তি খুব সজ্জন-সুলভ, এমন কথাও খড়গপুরে কেউ বলছে না। এই বাংলায় এক বার বিধানসভা আসন জিতে সেটা আগলানোর লড়াইয়ে হেরেছিলেন বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য। বিজেপি প্রার্থী প্রেমচন্দ্রের দাবি,তিনি পারবেন। লোকবল, অর্থবলও বিস্তর। সেই সঙ্গে তিনি বলছেন, ‘‘সঙ্গে দিলীপদা আছেন!’’

‘মেরে পাস মা হ্যায়’-এর মতো দিলীপদা আছেন,এই কথাটা তাঁকে বলতে হচ্ছে এমনি এমনি নয়। লোকসভা ভোটের সময়ের গেরুয়া হাওয়া ঝিমিয়ে পড়ার কারণেই হোক আর রেলে ঢালাও বেসরকারিকরণের চক্করে রেল-শহরের উদ্বেগের কারণেই হোক, বিজেপির রাজ্য সভাপতির ছেড়ে যাওয়া বিধানসভা আসন তাঁর দলের জন্য এ বার ততটা মসৃণ দেখাচ্ছে না। তার উপরে ‘বিজেপি বাঁচাও কমিটি’গড়ে হিরে চিহ্ন নিয়ে নির্দল দাঁড়িয়ে পড়েছেন প্রদীপ পট্টনায়ক। কাঁটা সামলাতে তাই প্রেমচন্দ্রের হুডখোলা জিপের সামনের সিটটা ছেড়ে রাখা আছে দিলীপ ঘোষের জন্যই। যে দিলীপবাবু মুসলিম মহ্ল্লায় প্রচারে সময় দেওয়াকে বিজেপির জন্য ‘ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট’ মনে করেন, তাঁকে এ বার পাঁচবেড়িয়ার সংখ্যালঘু পাড়ায় চায়ের দোকানে বসতে দেখা যাচ্ছে!

এবং একটু নজর করলেই আরও বোঝা যাচ্ছে, প্রদীপ-প্রেমচন্দ্রেরা আসলে দাবার বোড়ে। চাল দিচ্ছেন এ দিকে শুভেন্দু অধিকারী, ও দিকে দিলীপবাবু। বিধানসভায় দীর্ঘ দিন চাচার পাশে বসতেন যিনি, সেই মানস ভুঁইয়া তৃণমূলে এসে গত লোকসভা ভোটে দিলীপবাবুকে বধ করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন। ব্যর্থ হওয়ার পরে এ বার আর খড়গপুরে তাঁর প্রবেশাধিকার নেই, ধারে-কাছে নেই জেলার বাইরের তেমন কোনও ওজনদার নেতাও। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরছেন শুভেন্দু, দিনরাত ফোনে খবর রাখছেন। কোথাও বেচাল দেখলেই হুঁশিয়ারি, ‘‘খাতায় তোলা থাকছে! সব হিসেব হবে।’’ তিনি জানেন, লোকসভায় তৃণমূল বিজেপির চেয়ে পিছিয়ে ছিল প্রায় ৪৫ হাজার ভোটে। এই ২০১৯-ই তো শেষ কথা নয়। আছে ২০২১। তাই হিসেব তুলে রাখাও যায়।

তুলনায় দিলীপবাবু বেশ শান্ত। এলাকার কর্মীদের ডাকে সংসদের অধিবেশন ছেড়ে উপনির্বাচনের আগে শেষের ক’দিন খড়গপুরেই ঘাঁটি গেড়েছেন। রেলওয়ে গার্ডেনে সাংসদ-নিবাসে বসে তাঁর বিশ্লেষণ, ‘‘লোকসভায় এখানে যা পেয়েছিলাম, তার চেয়ে ভোট বাড়ানোর ডাক দিয়েছি। পুলিশ-প্রশাসন, সরকারি সব কিছুই ওরা ব্যবহার করছে। ভোটে অন্য জায়গা থেকে ছেলেও আনবে শুনছি। আমিও বলছি, আনুক। তারা ফিরে যাবে কি না, কী ভাবে যাবে, আমরা ঠিক করব!’’

হুঙ্কার, জৌলুস আর দেদার টাকা উড়ে বেড়ানোর মাঝে আরও এক জন লড়ছেন। স্তিমিত প্রচার,টোটো আর পায়ে হেঁটে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরছেন। রাস্তায় মাঝেমধ্যেই তাঁর পায়ে হাত ছোঁয়াচ্ছেন প্রাক্তন ছাত্রেরা। তাঁর হয়ে দিনরাত এক করে ছোট ছোট সভা করে চলেছেন কংগ্রেসের শুভঙ্কর সরকার,বামেদের তাপস সিংহ,বিপ্লব ভট্টেরা। বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী চিত্তরঞ্জন মণ্ডল বলছেন, ‘‘আমি এক জন ক্ষুদ্র শিক্ষক। এই শহরে দীর্ঘ দিন শিক্ষকতা করেছি। চাচাকে দেখে তাঁর আদর্শে রাজনীতি করেছি, কাউন্সিলর হয়েছি। মানুষ যদি নির্বাচিত করেন, চাচার আদর্শই ধরে রাখার চেষ্টা করব।’’

কিছু হোর্ডিং পড়েছে— চাচাজি’র গড়ে এ বার মাস্টারজি। ধুলো, টাকা আর অপরাধের গন্ধমাখা শহরটার ইতিউতি কিছু গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে,মাস্টারমশাই লোক ভাল। লোক ভাল হলে ভোট ভাল হয় কি না, জানে খড়গপুর!

অন্য বিষয়গুলি:

TMC Dilip Ghosh BJP Kharagpur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy