শাহকে পাঁচ প্রশ্ন মহুয়াদের। ফাইল চিত্র।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের উদ্দেশে ৫টি প্রশ্ন ছুড়ে দিল তৃণমূল। শাহের বাংলা সফরের ২৪ ঘণ্টা আগে সাংবাদিক বৈঠক করে তাঁর কাছে জবাব চাইলেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র এবং রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক। শাহের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছেও এর মধ্যে ৪টি প্রশ্নের উত্তর চেয়েছেন তাঁরা। প্রতিটি প্রশ্নকে ‘যুক্তিসঙ্গত’ করার জন্য দিয়েছেন একাধিক উদাহরণ।
মহুয়াদের প্রথম প্রশ্ন, মোদী-শাহেরা অহরহ দুর্নীতি মোকাবিলার কথা বললেও বিজেপির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে কেন দুর্নীতিতে অভিযুক্ত নেতাদের সরাননি? এ ক্ষেত্রে সরাসরি বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ এবং শুভেন্দু অধিকারীর নাম করেছে তৃণমূল। দিলীপের বিরুদ্ধে তৃণমূলের অভিযোগ, ‘‘২০২২ সালের নভেম্বরে, সিবিআই আধিকারিকেরা এএসসি নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত প্রসন্ন রায়ের বাসভবন থেকে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষের একটি নথি উদ্ধার করেছিলেন। দিলীপও তাঁর সঙ্গে প্রসন্নের পরিচয়ের কথা স্বীকার করেছিলেন। তা হলে কেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি এই বিষয়ে তদন্ত করছে না?’’
সম্প্রতি স্কুলে গ্রুপ-সি পদে নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ কলকাতা হাই কোর্ট যে ৫৫ জনের নাম বাতিল করেছে, শুভেন্দু তাঁদের নাম সুপারিশ করেছিলেন বলে মহুয়ার দাবি। সেই সঙ্গে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী মোদী দাবি করেছেন, যে পদে থাকুন বা যত ক্ষমতাশালীই হোন না কেন, কোনও দুর্নীতিগ্রস্তই রেহাই পাবেন না। তা হলে সিবিআইয়ের এফআইআর-এ নাম থাকা শুভেন্দু অধিকারী কী করে এখনও বিজেপিতে রয়েছেন?’’ শাহের কাছে তৃণমূলের দ্বিতীয় প্রশ্ন ‘রাজ্যের প্রাপ্য’ সংক্রান্ত বিষয়ে। বলা হয়েছে, ‘‘কেন্দ্রীয় তহবিল তাঁদের (মোদী-শাহ) ব্যক্তিগত অর্থ নয়। কেন্দ্রীয় তহবিল রাজ্য থেকে সংগ্রহ করা নানা কর থেকে আসে। তাঁরা আমাদের যে টাকা বরাদ্দ করেন, তা সেই করেরই একটি অংশ। তবে কেন কেন্দ্র বাংলার সাধারণ মানুষের প্রাপ্য টাকা আটকে রেখে নির্যাতন করছে?’’
মহুয়াদের অভিযোগ, ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে, বাংলায় ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের জন্য কোনও তহবিল মঞ্জুর করেনি কেন্দ্র। এখনও পর্যন্ত, ৭ হাজার কোটি টাকার বকেয়া রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গই একমাত্র রাজ্য যেখানে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের জন্য কেন্দ্রীয় তহবিল এখনও আসেনি। এর ফলে গত এক বছর ধরে ১৭ লক্ষ পরিবারকে সমস্যায় পড়তে হয়েছে।
একই ভাবে বাংলা আবাস যোজনায় সরকারি সাহায্যের জন্য ১১ লক্ষ ৩৬ হাজার পরিবারকে চিহ্নিত করা হলেও তা এখন কার্যকর করা যায়নি। কারণ, ওই খাতে কেন্দ্রের থেকে প্রাপ্য ৮,২০০ কোটি টাকা এখনও বাংলা পায়নি বলে তৃণমূলের অভিযোগ। সব মিলিয়ে মোদীর সরকার বাংলার ‘ন্যায্য প্রাপ্য’ ১ লক্ষ ১৫ হাজার কোটি টাকা আটকে রেখেছে!
সম্প্রতি, ২৫ জন তৃণমূল সাংসদের প্রতিনিধিদল কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহের সঙ্গে দেখা করে রাজ্যের প্রাপ্যের কথা জানাতে গিয়েছিল। মহুয়ার অভিযোগ, ‘‘পৌঁছে আমরা দেখতে পেলাম যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী কেউই উপস্থিত নেই। তাঁদের অনুপস্থিতির কোনও উপযুক্ত কারণ আমাদের জানানো হয়নি। এতেই বোঝা যাচ্ছে, কোনও সদুত্তর না থাকায় জবাবদিহি থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলেন মন্ত্রীরা।’’
তৃতীয় প্রশ্নে বাংলার নানা উন্নয়ন প্রকল্পে কেন্দ্রীয় নজরদারির ‘বাড়াবাড়ি’ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘‘গত দু’বছরে ১৫১টি কেন্দ্রীয় দলকে বাংলায় পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ৭১টি দল ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প এবং প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা (পিএমএওয়াই)-র কাজ খতিয়ে দেখতে এসেছিল। কেন আমরা শুধু বাংলার ক্ষেত্রেই এত বেশি নজরদারি দেখি? বিজেপি শাসিত কোনও রাজ্যে কি কোনও অনিয়ম হচ্ছে না?’’ বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশের সাতনায় যে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসেছে, সে কথা শাহকে মনে করিয়ে দিয়েছে তৃণমূল।
২০২৩-২৪ বাজেটে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে বরাদ্দ ছাঁটাই নিয়েও শাহের উদ্দেশে প্রশ্ন ছোড়া হয়েছে। ২০২২-২৩ বাজেটে ৭৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলেও চলতি অর্থবর্ষে তা কমে ৬০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এর ফলে ওই প্রকল্প রূপায়ণে প্রথম সারিতে থাকা বাংলা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের অভিযোগ।
বাংলার প্রতি বিজেপির ‘অকৃতজ্ঞতার কারণ’ও জানতে চাওয়া হয়েছে সাংবাদিক বৈঠকে। বিজেপিকে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে ১৮টি এবং ২০২১-এক বিধানসভা ভোটে ৭০টি আসনে জেতানোর পরেও কেন বাংলার জনগণ বঞ্চনার শিকার হচ্ছে, শাহের কাছে তার উত্তর চেয়েছেন মহুয়ারা। তাঁদের দাবি, কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের এক সচিব পর্যায়ের আধিকারিক জানিয়েছেন, তাঁরা অর্থ বরাদ্দ করতে চাইলেও বাংলার বিরোধী দলের (এ ক্ষেত্রে বিজেপি) আপত্তির কারণে তা কার্যকর হচ্ছে না। দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্তা প্রকাশ্যে ১০০ দিনের প্রকল্পের টাকা আটকানোর ‘কৃতিত্ব’ দাবি করেছেন! তার আগে শুভেন্দু এবং বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও প্রকাশ্যে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ আটকে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন বলে তৃণমূলের অভিযোগ। সম্প্রতি, রাজ্যের বিরুদ্ধে রোজগার নিশ্চয়তা আইনের ২৭ নম্বর ধারা না মানার অভিযোগ তুলে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ আটকানোর হুমকি দিয়েছিলেন শুভেন্দু। এমনকি, বাংলা সফরে আসা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির কাছে বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পালও বরাদ্দ আটকানোর দাবি জানিয়েছিলেন বলে তৃণমূলের দাবি।
চতুর্থ প্রশ্নে সম্প্রতি খুন হওয়া কয়লা ব্যবসায়ী রাজু ঝায়ের সঙ্গে ‘বিজেপির সম্পর্ক’ জানতে চাওয়া হয়েছে। প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে কেন পদ্মশিবির এখনও নীরব? দলের প্রশ্ন, ‘‘গত বছরের নভেম্বরে, কেন্দ্রীয় কয়লামন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী যখন দু’দিনের সফরে বাংলায় এসেছিলেন, তখন তিনি রাজুর হোটেলে ছিলেন! এলাকায় অন্যান্য হোটেল এবং ইসিএল-এর গেস্ট হাউস থাকা সত্ত্বেও কেন কেন্দ্রীয় কয়লামন্ত্রী রাজুর হোটেলে বেছে নিলেন?’’
২০২০ সালের ওই সফরে প্রহ্লাদের সভায় জয়দের খাঁ নামে এক ‘কয়লা মাফিয়া’ ছিলেন বলেও তৃণমূলের দাবি। পাশাপাশি, ২০২১-এ নীলবাড়ির লড়াইয়ের আগে বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয়বর্গীয় এবং দিলীপের সহায়তায় রাজু পদ্মশিবিরে যোগ দিয়েছিলেন বলে দাবি করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহের উদ্দেশে সরাসরি পঞ্চম প্রশ্ন ছুড়েছেন মহুয়ারা— ‘‘কেন গুজরাতের বিলকিস বানো গণধর্ষণ মামলার দোষীদের মুক্তি বা হাওড়ার হিংসায় জড়িত সুমিত সাউয়ের (বিহার থেকে ধৃত) বিষয়ে আপনি কোনও কথা বলেন না? সুমিতের সঙ্গে তো বিজেপির সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা গিয়েছে।’’ দলের অভিযোগ, ‘‘বিহারের জনসভার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতীয় আইন এবং বিচার ব্যবস্থাকে অপমান করে বলেছিলেন, ‘দাঙ্গাবাজদের উল্টে ঝোলানো হবে’। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হল, বাংলায় রামনবমীর মিছিলে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে নাচতে থাকা অভিযুক্তকে (সুমিত) যখন ধরা হয়, তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কিছু বলতে শোনা যায় না। কেন এমন দ্বিচারিতা?’’
শুধু বাংলা নয়, দেশে কেন সমস্ত গোষ্ঠীহিংসার ঘটনার সঙ্গে বিজেপির যোগসূত্র মেলে তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে তৃণমূল। প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ‘‘কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সফরের এক দিন আগে বিহারে বিস্ফোরণ কি নিছকই কাকতালীয়?’’
উত্তরপ্রদেশে একের পর এক ‘সাজানো পুলিশি সংঘর্ষে খুন’ এবং বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ নিয়েও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অবস্থান জানতে চান তাঁরা। মনে করিয়ে দেন, কলকাতা এখনও মহিলাদের কাছে ‘সবচেয়ে নিরাপদ শহর’। মহুয়ার প্রশ্ন, ‘‘নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও কেন সংসদে এত দিন মহিলা সংরক্ষণ বিল মোদী সরকার আনেনি? কেন আইনসভায় বিজেপির মহিলা সদস্যের সংখ্যা ২০ শতাংশও নয়?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy