গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
রাজ্যপাল নির্দেশ দিয়েছিলেন এক। হল আর এক! শেষ পর্যন্ত সেই নির্দেশ অগ্রাহ্য করে নতুন নির্বাচিত দুই তৃণমূল বিধায়ককে শপথবাক্য পাঠ করালেন বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পরেই রাষ্ট্রপতির কাছে রিপোর্ট পাঠালেন ‘ক্ষুব্ধ’ রাজ্যপাল। তিনি দাবি করলেন, সংবিধান অমান্য করেছেন স্পিকার। বিমান যদিও এ সবে আমল দিতে নারাজ। তিনি জানিয়ে দিলেন, স্পিকারকে সরানো যাবে না।
বিধানসভা উপনির্বাচনে ভগবানগোলা কেন্দ্রে জয়ী হন রেয়াত হোসেন সরকার। বরাহনগর কেন্দ্রে জয়ী হন সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত ৪ জুন লোকসভা নির্বাচনের ফলের সঙ্গে এই দুই বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনের ফল ঘোষণা হয়। কিন্তু নতুন নির্বাচিত বিধায়কদের শপথগ্রহণ নিয়ে তৈরি হয় জট। সায়ন্তিকারা দাবি করেন, রাজভবনে গিয়ে শপথ তাঁরা নেবেন না। শপথগ্রহণ করবেন বিধানসভাতেই। তাতে সিলমোহর দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই প্রেক্ষিতে তিনি বলেছিলেন, ‘‘রাজভবনে যা কীর্তি-কেলেঙ্কারি চলছে, তাতে মেয়েরা যেতে ভয় পাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে আমাকে।’’ অন্য দিকে, রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসও অনড় ছিলেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, রাজভবনে গিয়েই নিতে হবে শপথ। বিধানসভাতে শপথ নেওয়ার দাবিতে অম্বেডকরের মূর্তির পাদদেশে ধর্নায় বসেন সায়ন্তিকারা। তার মধ্যেই স্পিকার বিমান এবং রাজ্যপালের মধ্যে শুরু হয় চিঠি বিনিময়। রাষ্ট্রপতিরও দ্বারস্থ হন বিমান। গত এক মাস ধরে এই নিয়ে টানাপড়েনের মাঝে বৃহস্পতিবার রাজ্যপাল জানিয়ে ছিলেন, ডেপুটি স্পিকার আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ই শপথ পাঠ করাবেন দুই বিধায়ককে। শুক্রবার সকালে বিধানসভার কার্য উপদেষ্টা কমিটিও তা মেনে নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু বেলা বাড়তেই ঘটনার প্রবাহ অন্য খাতে বইতে শুরু করে দেয়।
আশিস জানিয়ে দেন, স্পিকারের উপস্থিতিতে তিনি ওই দায়িত্ব নিতে পারবেন না। এর পরেই সায়ন্তিকাদের শপথগ্রহণ করান বিমান। নির্বাচিত হওয়ার প্রায় এক মাস পর শপথ নেন দুই বিধায়ক। শপথ পাঠ করানোর সময় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তোলেন তৃণমূলের বিধায়কেরা। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। নিজের নিযুক্ত প্রতিনিধি শপথ পাঠ করাননি, অভিযোগ জানিয়ে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দেন রাজ্যপাল। দাবি করেন, সংবিধান ভাঙা হয়েছে। স্পিকার যদিও স্পষ্টই জানিয়ে দেন, কোন ধারায় তিনি শপথ পাঠ করিয়েছেন। তিনি জানান, যে হেতু বিধানসভার অধিবেশন চালু রয়েছে, তাই রাজ্যপালের চিঠি মান্যতা পেল না। রুলস অফ বিজ়নেসের ২ নম্বর অধ্যায়ের ৫ নম্বর ধারা মেনেই তিনি শপথবাক্য পাঠ করিয়েছেন সায়ন্তিকাদের। রাজ্যপাল তা মানতে চাননি। তিনি দাবি করেছেন, সংবিধান অমান্য করা হয়েছে। যেখানে রাজ্যপাল শপথ পাঠ করানোর জন্য কাউকে নিযুক্ত করেছেন, সেখানে স্পিকার কী ভাবে তা করাতে পারেন? তখনই স্পিকার ওই ধারার উল্লেখ করেন। এ-ও জানিয়ে দেন, রাষ্ট্রপতিকে রিপোর্ট পাঠানোয় তিনি আনন্দিত হয়েছেন। কারণ বিষয়টি আগেই তিনি জানিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতিকে। আর তাঁকে অপসারণের ক্ষমতা নেই রাজ্যপালের, সে কথাও স্মরণ করিয়ে দেন।
কার্য উপদেষ্টা কমিটি
শুক্রবার সকালে বিধানসভার কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, রাজ্যপাল নিযুক্ত প্রতিনিধি ডেপুটি স্পিকার আশিস শপথবাক্য পাঠ করাবেন নতুন নির্বাচিত বিধায়ক সায়ন্তিকা এবং রেয়াতকে। বরাহনগর থেকে জয়ী সায়ন্তিকা এবং ভগবানগোলা কেন্দ্রে জয়ী রেয়াতের শপথগ্রহণ নিয়ে গত প্রায় একমাস ধরে টানাপড়েন চলছিল রাজভবন এবং বিধানসভার মধ্যে। গত ২০ জুন থেকে তা কার্যত স্পিকার বনাম রাজ্যপালের ‘যুদ্ধে’ পর্যবসিত হয়। প্রথমে দু’পক্ষের চিঠি বিনিময় হয়। তার পরে বিধানসভাতেই শপথ গ্রহণ করবেন দাবি তুলে ধর্নায় বসেন সায়ন্তিকারা। অবশেষে বৃহস্পতিবার আচমকাই রাজ্যপাল বোস জানান, দুই হবু তৃণমূল বিধায়ককে রাজভবনে আসতে হবে না। তাঁরা বিধানসভাতেই ডেপুটি স্পিকারের কাছে শপথগ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু সেই সম্ভাবনা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয় ডেপুটি স্পিকার আশিস তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে ওই দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহ প্রকাশ করায়। ডেপুটি স্পিকার আশিসের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানা গিয়েছিল, তিনি জানিয়েছেন, হবু বিধায়কদের শপথবাক্য পাঠ করাতে তিনি আগ্রহী নন। শুক্রবার অবশ্য বিধানসভা সচিবালয় সূত্র দাবি করেছিল, রাজ্যপালের দেওয়া দায়িত্ব মেনে নিয়ে সায়ন্তিকাদের শপথ পাঠ করাতে রাজি আশিস। কিছু ক্ষণ পরেই অন্য ঘটনা দেখা যায়।
শপথপাঠ করালেন বিমানই
শুক্রবার বিধানসভায় সায়ন্তিকাদের শপথবাক্য পাঠ করান বিধানসভার স্পিকার বিমানই। যেমনটি চেয়েছিলেন সায়ন্তিকারা। আশিস জানিয়ে দেন, তিনি স্পিকারের উপস্থিতিতে কোনও ভাবেই ওই দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। স্পিকার বিমানকে তিনিই অনুরোধ করেন তৃণমূলের জয়ী প্রার্থীদের শপথ গ্রহণ করানোর বিষয়ে। তাঁর অনুরোধেই বিমানই শপথ গ্রহণ করান সায়ন্তিকাদের। শপথ পাঠ করানোর সময় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তোলেন তৃণমূলের বিধায়কেরা। স্বয়ং রাজ্যপাল যেখানে নিজের প্রতিনিধি হিসাবে ডেপুটি স্পিকারকে নিয়োগ করেছেন, সেখানে স্পিকার কি এই দায়িত্ব পালন করতে পারেন? এই প্রশ্নের জবাব বিধানসভাতেই দেন বিমান। তিনি জানান, যে হেতু বিধানসভার অধিবেশন চালু রয়েছে, তাই রাজ্যপালের চিঠি মান্যতা পেল না। রুলস অফ বিজ়নেসের ২ নম্বর অধ্যায়ের ৫ নম্বর ধারা মেনেই তিনি শপথবাক্য পাঠ করিয়েছেন সায়ন্তিকাদের। শুক্রবার শপথগ্রহণের পর প্রাক্তন বিধায়ক জুন মালিয়ার আসনটিতেই বসতে দেওয়া হয় সায়ন্তিকাকে। রেয়াতকে দেওয়া হয় নতুন আসন। প্রসঙ্গত, জুন এখন মেদিনীপুরের সাংসদ।
রাষ্ট্রপতিকে রাজ্যপালের নালিশ
বিমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির কাছে ‘নালিশ’ জানিয়েছেন রাজ্যপাল। একটি রিপোর্ট দিয়ে তিনি অভিযোগ করেন, স্পিকার বিমান সংবিধান অমান্য করে তৃণমূলের দুই বিধায়ককে শপথবাক্য পাঠ করিয়েছেন। রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া রিপোর্টে রাজ্যপাল জানিয়েছেন, সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী বিধানসভার ডেপুটি স্পিকারকে শপথবাক্য পাঠ করানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রাজভবনের তরফে। কিন্তু স্পিকার সেই নির্দেশ অমান্য করে সংবিধানকেও অমান্য করেছেন। শুক্রবার বিধানসভায় সায়ন্তিকাদের শপথগ্রহণ পর্ব শেষ হওয়ার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই রাজভবনের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে বিষয়টি পোস্ট করে নিজের বক্তব্য জানিয়েছেন রাজ্যপাল বোস। কয়েকটি প্রশ্ন এবং উত্তরের মাধ্যমে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন তিনি। রাজ্যপাল জানান, স্পিকারের সংবিধান অমান্য করা নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে একটি রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বিমান নিয়মের কথা জানিয়েছিলেন। রাজ্যপাল তা উড়িয়ে জানিয়েছেন, ‘‘এটি একটি অত্যন্ত সাধারণ জ্ঞান যে, সংবিধান সমস্ত নিয়মের ঊর্ধ্বে।’’
আনন্দে স্পিকার
রাষ্ট্রপতির কাছে তাঁর নামে রাজ্যপাল রিপোর্ট পাঠিয়েছেন শুনে নির্বিকারই ছিলেন স্পিকার বিমান। জানান, তিনি এতে আনন্দিত হয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘খুব আনন্দের কথা। আমি আরও খুশি হতাম, যদি উনি আগেই এটা করতেন। কারণ রাষ্ট্রপতিকে আমরা আগে জানিয়েছি।’’ রাষ্ট্রপতিকে রিপোর্ট পাঠানোর কথা সমাজমাধ্যমেও লিখেছেন রাজ্যপাল। এই প্রসঙ্গে বিমান জানান, রাজ্যপালের কোনও সমাজমাধ্যম পোস্টের জবাব তিনি দেবেন না। তিনি যা করার, আইনসঙ্গত ভাবেই করেছেন। আর তা বিধানসভায় নথিভুক্তও হয়ে গিয়েছে। বিমানের কাছে এর পরে জানতে চাওয়া হয়, রাষ্ট্রপতির কাছে রিপোর্ট পাঠালে এ নিয়ে নতুন করে আর কোনও জটিলতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কি? জবাবে বিমান আত্মবিশ্বাসের সুরেই জানান, রাজ্যপালের কোনও ক্ষমতা নেই স্পিকারকে অপসারণ করার। আর রাষ্ট্রপতিরও সেই ক্ষমতা নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy