তৃণমূলের চিকিৎসক-বিধায়ক নির্মল মাজি ফাইল চিত্র।
রাজ্যের অন্যতম প্রধান মেডিক্যাল কলেজের এক প্রবীণ পরীক্ষক এমএস পরীক্ষার খাতা দেখে কয়েক জন পড়ুয়াকে ফেল করিয়েছেন। সে কথা জানাজানি হওয়ার পরে তাঁর কাছে ‘নির্দেশ’ আসে, রেজাল্ট বদলে ফেলতে হবে। ফেল করানো চলবে না কোনও ভাবেই। পরীক্ষকের উত্তর, পরীক্ষার্থীরা যা লিখে এসেছেন, তার ভিত্তিতে পাশ করানো কার্যত অসম্ভব।
বিষয়টা এখানেই থেমে যেতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। অভিযোগ, এর পর স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় বৈঠক ডেকে ফেল করা পরীক্ষার্থীদের পাশ করানোর ‘প্রস্তাব’ দেয় পরীক্ষকদের এবং তার পর, রেজাল্ট বদলে বেশ কয়েক জন পরীক্ষার্থী ফেল-এর বদলে পাশ করে গিয়েছেন রাতারাতি। স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষকর্তাদের দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠার পাশাপাশি এই ঘটনায় ‘মূল কান্ডারি’ হিসেবে ফের উঠে এসেছে তৃণমূলের চিকিৎসক-বিধায়ক নির্মল মাজির নাম। অভিযোগ, ‘মুখ্যমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে’ পরীক্ষকদের উপরে চাপ সৃষ্টি করছিলেন তিনিই এবং ‘মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট দেখেছেন তো? দিদি চান, ডাক্তারিতেও তাই হবে’—এমনই উক্তি নাকি বার বার শোনা গিয়েছে তাঁর মুখে।
এ-ও অভিযোগ, ‘ফেল’ বদলে ‘পাশ’ হওয়ার পরে নির্মল-অনুগামীরা ফোনে, এমনকি, প্রকাশ্যেও দাবি করে বেড়াচ্ছেন, ‘শুধু ট্রান্সফার-পোস্টিং নয়, পরীক্ষায় পাশ করানোও দাদার হাতে।’ এত দিন এমবিবিএস পরীক্ষায় নির্মল মাজির ‘হাতযশ’এর অভিযোগ উঠেছে বার বার। এ বার এমডি (ডক্টর অব মেডিসিন), এমএস ((মাস্টার অব সার্জারি)-এর মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরির পরীক্ষাকে ঘিরেও এমন অভিযোগ সামনে আসায় উদ্বিগ্ন প্রবীণ চিকিৎসক মহল। তাঁদের প্রশ্ন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মান যদি এই দাঁড়ায়, এর পরে সাধারণ মানুষ কাদের উপরে নিজেদের জীবনরক্ষার ভার ছেড়ে দেবেন? কেন প্রশাসন কড়া পদক্ষেপ করে অবিলম্বে এই অনিয়ম বন্ধ করবে না?
নির্মল মাজিকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হোক বা পাশ-ফেল, আমি কোনও কিছুর মধ্যেই থাকি না। আমি নিজের বিধানসভা এলাকার উন্নয়ন নিয়েই ব্যস্ত এখন। সামনেই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের রোগী কল্যাণ সমিতির মনোনয়ন। আমি যাতে কোনও ভাবেই চেয়ারম্যান মনোনীত না হতে পারি, তাই এই ষড়যন্ত্র।’’ অভিযোগ অস্বীকার করেন স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুহৃতা পাল-ও।
এমডি, এমএস পরীক্ষা হয়েছিল গত জুলাই মাসের শেষে। ২৮ অগস্ট তার ফল প্রকাশিত হয়। তার আগে ২৬ অগস্ট পরীক্ষকদের অনলাইন বৈঠকে ডাকে স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়। দুপুর ৩টে থেকে ৪টে পর্যন্ত চলে সেই বৈঠক। সূত্রের খবর, সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ছাড়াও ইএস আই মেডিক্যাল কলেজ এবং কমান্ড হাসপাতালের প্রতিনিধিও ছিলেন। সেই বৈঠকে স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্তা ফেল করা পরীক্ষার্থীদের পাশ করিয়ে দেওয়ার ‘অনুরোধ’ করেন বলে অভিযোগ। বলা হয়, পাশ করিয়ে দেওয়ার বিষয়টি তাঁরা যেন সংশ্লিষ্ট কলেজের অধ্যক্ষদের মারফত ই-মেল করে স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়কে জানান। কয়েক জন সে নিয়ে আপত্তি তোলেন। অভিযোগ, তখনই ‘অনুরোধ’ কার্যত বদলে যায় ‘প্রস্তাবে’। তাঁদের বলা হয়, তাঁরা যেন নিজেদের কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন। এর পরে অধিকাংশ পরীক্ষক বিষয়টি মেনে নিলেও হাতে গোনা দু’এক জন মানেননি।
বিষয়টি গত কয়েক দিনে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এক প্রবীণ শিক্ষক-চিকিৎসকের কথায়, ‘‘তরুণ চিকিৎসকদের বড় অংশই গোটা ব্যবস্থার প্রতি হতাশ, বীতশ্রদ্ধ। তাঁদের বক্তব্য, কাজ করে, পড়াশোনা করে কী লাভ? ধামাধরা হয়ে থেকে অযোগ্য লোকেরাই তো সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে।’’ খবর পৌঁছেছে স্বাস্থ্য ভবনেও। তার পরেও কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ। দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘আমরা কী করব? এমবিবিএস-এ ভর্তির কাউন্সেলিং থেকে শুরু করে কলেজে ভর্তি, এমবিবিএস পরীক্ষার খাতা দেখা, মৌখিক পরীক্ষায় কোন পরীক্ষার্থী কার টেবিলে— সবেতেই নির্মল মাজি দখল নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বহু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন। এ গুলো জেনেও সবাই চুপ করে থাকেন, কারণ, মুখ খুললেই খাঁড়া নামবে। প্রত্যন্ত জেলায় বদলি কিংবা কম্পালসারি ওয়েটিং-এর ঝুঁকি সাধ করে কে নেয়?’’
স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, বৈঠকে যখন নিজের নিজের মেডিক্যাল কলেজের পরীক্ষার্থীদের পাশ করিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়, তখন বিস্মিত হয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন, কার হাতে কোন কলেজের খাতা, সেটা তো তাঁরা জানেন না। তা হলে নিজেদের কলেজের কথা উঠছে কী ভাবে? নিয়ম অনুযায়ী, পরীক্ষকদের কাছে যে খাতা আসে, তাতে পরীক্ষার্থীর নাম বা রোল নম্বর থাকে না। শুধু কোড নম্বর থাকে। এক কলেজের খাতা যাওয়ার কথা অন্য কলেজে। অভিযোগ, ওই বৈঠকে তাঁদের জানানো হয়, এ বার এক কলেজের খাতা অন্য কলেজে যায়নি। নিজেদের কলেজের খাতাই সকলে পেয়েছেন। কেন এই নিয়ম বদল? উপাচার্য বলেন, ‘‘এ বিষয়ে কিছুই জানি না। আর কোডিং-এর ব্যবস্থা যখন আছে, তখন কোন খাতা কোথায় গেল, সেটা আমার জানার কথা নয়।’’
বৈঠকে কি পাশ করানোর ব্যাপারে পরীক্ষকদের বলা হয়েছিল? উপাচার্যের জবাব, ‘‘ওই বৈঠকে আমি উপস্থিত ছিলাম না। তাই কী কথা হয়েছে জানি না। যত দূর শুনেছি, প্রযুক্তিগত সমস্যার জন্য যাতে কোনও পরীক্ষার্থীর ফল ভুল না হয়, সেটাই নিশ্চিত করতে বলা হয়েছিল। তবে পাশ করিয়ে দেওয়ার কথা কেন বলা হবে? আমাদের কী স্বার্থ? যত দূর মনে পড়ছে, ১১৭৫ জন পরীক্ষা দিয়েছিলেন। মাত্র ২৮ জন পাশ করতে পারেননি।’’
উপাচার্য স্বীকার না করলেও স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তাদের একটি অংশের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা কাজে অনেক দিন ধরেই হস্তক্ষেপ করছেন নির্মল। এর আগের একাধিক উপাচার্যের আমলেও এটা হয়েছে। এক কর্তার কথায়, ‘‘এখনই এর রাশ না টানলে সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy