ফাইল চিত্র।
মুখ ঢাকা মাস্কে। চোয়াল শক্ত। হাসছেন না উদয়ন গুহ।
অথচ এতটা গম্ভীর থাকারও কিছু নেই এখন, বলছেন সঙ্গীরাই। প্রচারে দিনভর চরকিপাক দেওয়ার মধ্যেই তাঁরা জানিয়ে যাচ্ছেন, দু’বছর আগে যে দিনহাটা কেন্দ্র থেকে নিশীথ প্রামাণিক সাড়ে ১৫ হাজারে ‘লিড’ পেয়েছিলেন, সেখানে এ বারে ব্যবধান কমে মোটে ৫৭। পরের ছ’মাসেও বিজেপি এখানে এমন কিছু করেনি যে হইহই করে এই ব্যবধান বাড়িয়ে নিয়ে যাবে বা অন্তত ধরে রাখা যাবে। তবু ‘দাদা’ গম্ভীর।
দিনহাটায় তাঁর বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে দেখা গেল, গলির সবটা ছেয়ে রয়েছে তৃণমূলের পতাকায়। বাড়ির সামনে হাজির জনা দশেক যুবক। অন্দরমহলে পা রাখতে গেলে তাঁদের প্রশ্নমালা পার হতে হয়। তার পরে দেখা মেলে উদয়নের। যিনি বলেন, ‘‘এ বার মনে হয় রেকর্ড মার্জিনে জিতব।’’ দলের কেউ কেউ অন্তর্ঘাত করতে পারে কি— এমন প্রশ্ন তিনি ফুৎকারে উড়িয়ে দেন: ‘‘সাহস নেই কারও। কেউ চেষ্টা করলে কর্মীরাই ব্যবস্থা নেবেন।’’ তবু মুখের রেখা কাঁপে না তাঁর। হাসেন না উদয়ন।
দিনহাটা তাঁর খাসতালুক বললে কম বলা হয়। বাবা কমল গুহ ছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাম নেতা। ছেলেও এক সময়ে বাম টিকিটেই ভোটে লড়েছেন। ২০০৬ সালে অবশ্য উদয়ন হেরেছিলেন সেই সময়ের তৃণমূলের প্রার্থী অশোক মণ্ডলের কাছে। ঘটনাচক্রে সেই অশোকই এ বারে তৃণমূলের উদয়নের বিরুদ্ধে বিজেপি প্রার্থী। প্রচারে বার হলেও যাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন লোকজন। সেই চাপ সামলাতে যাঁকে এর মধ্যেই আধাসেনার ঘেরাটোপে ঢুকে পড়তে হয়েছে। এবং যাঁর পাশে চট করে দেখা যাচ্ছে না নিশীথ প্রামাণিককে।
অথচ গত দু’বছর দিনহাটার মাঠেঘাটে একজনই টক্কর নিয়েছিলেন উদয়নের। তিনি নিশীথ। লোকসভার সাংসদকে বিধানসভা ভোটেও প্রার্থী করেছিল বিজেপি। দলের অন্দরে কানাঘুষো ছিল, দল জিতলে রাজ্যে মন্ত্রী হতে পারতেন তিনি। কিন্তু বিধানসভা ভোটে সেই রামও এল না, সেই অযোধ্যাও রইল অধরাই।
রাজ্যের ধারার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পনেরো হাজারি দিনহাটায় দম চাপা উত্তেজনা পুইয়ে শেষতক নিশীথ জিতলেন মোটে ৫৭ ভোটে। রাজ্যে স্বপ্নভঙ্গের পরে কেন্দ্রে উন্নতি হল তাঁর। হলেন অমিত শাহের অন্যতম ডেপুটি। আর কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তাঁকে চট করে দেখা যায় না এলাকা, বলছেন তাঁর দলেরই লোকজনেরা।
একটা সময় তো নিশীথের জন্য প্রায় ‘নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা’ জারি করতে যাচ্ছিলেন দলীয় কর্মীরা। তাঁরই জয়ের পরে ছেড়ে দেওয়া আসনে উপনির্বাচন। সেখানেও তাঁকে বিশেষ একটা দেখা যাচ্ছে না, অভিমান দলের কর্মীদের মুখেই।
আর শুধু কি এই উপনির্বাচন? ২ মে-র পরে এই দিনহাটা থেকেই বারবার তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘ভোট পরবর্তী সন্ত্রাসের’ নালিশ করেছেন বিজেপি কর্মীরা। রাজ্যে হারের শোকে এলাকায় জয়ের আনন্দ হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই সময়ও কি তাঁরা দলের নেতাদের পাশে পেয়েছেন?
ভেটাগুড়িতে নিশীথের বাড়ি থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে এক বিজেপি কর্মী বলেন, “বিধানসভা ভোটের পরে আমাদের উপরে হামলা হল, দলের কাউকেই পাশে পাইনি।’’ একটু থেমে বলেন তিনি, ‘মন্ত্রীকেও না।” এই দায় এড়াবেন কী ভাবে বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরা? বিজেপির কোচবিহার জেলার সভানেত্রী মালতী রাভা অবশ্য বলেন, ‘‘এমন কথা ঠিক নয়। আমরা সবাই মিলে বারে বারে কর্মীদের কাছে গিয়েছি। তৃণমূলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি।’’
ক্ষোভ কি উদয়নের দিকেও নেই? তৃণমূলেরই এক নেতা নাম উল্লেখ না করার শর্তে বলেন, ‘‘কোচবিহারে দলে অজস্র ভাগ। আর সকলেই অন্যের ক্ষতি করতে তৈরি। এই তো, অনেক কষ্টে রবীন্দ্রনাথ ঘোষ আর পার্থপ্রতিম রায়কে একসঙ্গে আনছেন জেলা সভাপতি গিরীন্দ্রনাথ বর্মণ। কিন্তু আখেরে কি ফাটল জোড়া লাগছে? তা হলে কেন রবীন্দ্রনাথকে দক্ষিণবঙ্গে প্রচারে পাঠানো হল?’’
দলের নিচুতলাতেও কিন্তু ছোট ছোট ক্ষোভ ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে কর্মী উদয়নের সঙ্গে প্রচারে বার হয়েছেন, তিনিই পদযাত্রা শেষে নিচুগলায় বলে গেলেন, ‘‘উদয়নদা আমাদের কখনও দেখেননি। জানি, এ বারে জিতলেও দেখবেন না।’’
তবু তৃণমূলের মিছিলে হইচই চোখে পড়ার মতো। কর্মীরা প্রচারে হাঁটতে হাঁটতেই প্রশ্ন তুলছেন— দাদা দিনদুপুরে দিনহাটার মাঝে মার খেলেন, আর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বলে গেল তিনিই অপরাধী! কী ভাবে? উদয়নও বলছেন, ‘‘আমি নিজেই তো আক্রান্ত।’’
বলছেন, এবং হাত নাড়তে নাড়তে মিছিল নিয়ে এগোচ্ছেন। চোয়াল সেই শক্তই। মুখে কিন্তু হাসি নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy