তাপস রায়। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
বিরোধী পক্ষে থাকাকালীন তিনি নিয়মিত বিধানসভায় পুলিশ বাজেট নিয়ে বিতর্কে অংশ নিতেন। ঝাঁঝালো বক্তৃতা করতেন। রাজনীতির কারবারিরা জানতেন, বরাবরই পুলিশে (মতান্তরে উর্দিধারী বাহিনী নিয়ে) তাঁর ‘রুচি’ রয়েছে। সেই তিনি, অধুনা তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায়ের বাড়িতে শুক্রবার সকাল থেকে জলপাইরঙা উর্দিধারীদের প্রহরায় হানা দিয়েছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। তাপসের বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের বাড়ি ঘিরে রেখেছেন সশস্ত্র সিআরপিএফ জওয়ানেরা। মুচিপাড়া থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছে বটে, কিন্তু তারা ফটকের ভিতরে যাওয়ার কোনও সুযোগ পাননি। বাড়ির উপরতলায় তো বটেই, বাড়ির এক তলায় তাপসের রাজনৈতিক দফতরেও তল্লাশ চালাচ্ছে ইডি।
তিন তলা বাড়ির ভিতরে যখন তল্লাশি চালাচ্ছে ইডি, জিজ্ঞাসাবাদ করছে তাপসকে, তখন তৃণমূলের মধ্যে একাংশের মধ্যে বিস্ময়—তাপস রায়! আর অন্য অংশে হা-হুতাশ— আবার ‘ভুলভাল’ কারণে খবরে এলেন তাপস!
মন্ত্রী সুজিত বসুর বাড়িতেও শুক্রবার প্রায় একই সময় থেকে তল্লাশি শুরু করেছে ইডি। কিন্তু সুজিত নিয়ে তৃণমূলে কোনও বিস্ময় নেই। কারণ, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রকাশ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, এর পরে সুজিত ইডির আতশকাচের তলায় রয়েছেন। একই আশঙ্কা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেছিলেন সুজিত নিজেও। কিন্তু তাপসের বাড়িতে যে ইডি যেতে পারে, তা তৃণমূলের নেতাদের কাছে কল্পনাতীত ছিল। শাসক তৃণমূল তো নয়ই, বিরোধী বিজেপি বা সিপিএম নেতারাও কখনও তাপসের নাম বলেননি। শাসকদলের অনেকের বক্তব্য, সন্দেশখালির ‘পাল্টা’ হিসেবে ইডি তাপসের বাড়িতে গিয়েছে। এ আসলে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’।
তৃণমূলের প্রথম সারিতে তিন ‘রায়’ আছেন। প্রথম: মুকুল রায়। যিনি অবশ্য এখন সক্রিয় রাজনীতি থেকে অনেক দূরে। দ্বিতীয়: সৌগত রায়। দমদমের বর্ষীয়ান সাংসদ নবীন-প্রবীণ বিতর্কে ‘উদাহরণ’ হিসেবে উল্লিখিত হয়েছেন দলনেত্রীর ভাষণে। তৃতীয়: রায় তাপস। যিনি দ্বিতীয় রায়ের অনুগত এবং অনুগামীও বটে।
ঘটনাচক্রে, সম্প্রতি বার বার খবরে এসেছেন তাপস। কখনও তিনি নবীন-প্রবীণ বিতর্কে মন্তব্য করেছেন প্রকাশ্যে। দলের অন্দরে নবীন-প্রবীণ বিতর্কে পঁয়ষট্টি-ঊর্ধ্ব তাপস অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়সনীতিকে সমর্থন করেছেন। প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘‘আমি প্রবীণ হলেও নবীনেরই পক্ষে। নবীনের নেতৃত্বে আমার আস্থা আছে।’’
আবার কখনও সরাসরি বিঁধেছেন উত্তর কলকাতার তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। উত্তর কলকাতার রাজনীতিতে তাপস বরাবরই সুদীপ-বিরোধী। তাপস তা গোপনও করেন না। কখনও তিনি সুদীপ সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘ওর জ্ঞান শুনব না! সুদীপ মাঝে তৃণমূল ছেড়ে দিয়ে জোড়া মোমবাতি করত। আমি ওর থেকে বেশি দিন তৃণমূল করছি।’’ কখনও সুদীপকে বলেছেন ‘সাদা হাতি’! সুদীপকে আক্রমণ অবশ্য তাপসের নতুন নয়। কয়েক মাস আগে সুদীপের উদ্দেশে তাপস বলেছিলেন, ‘‘আমি জেল খাটা আসামি নই! আমার গায়ে কেউ এক ফোঁটা কালি ছেটাতে পারবে না!’’ নাম না করে তাপস বলতে চেয়েছিলেন রোজ়ভ্যালি মামলায় সুদীপের ভুবনেশ্বর জেলে বন্দি থাকার কথা। ব্যক্তিগত সততা নিয়ে যে তাপসের কণ্ঠে শ্লাঘাবোধ ছিল, তাঁর বাড়িতেই নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে হানা দিল ইডি!
সত্তরের দশক থেকে রাজনীতি করছেন তাপস। অধুনা প্রয়াত সোমেন মিত্রের হাত ধরেই কংগ্রেসি রাজনীতিতে হাতেখড়ি তাঁর। তরুণ বয়স থেকেই ডাকাবুকো তাপসকে একটা সময়ে বলা হত, ‘ছোড়দা’র (সোমেন এই নামেই পরিচিত ছিলেন রাজনৈতিক বৃত্তে) সবচেয়ে কাছের লোক। ভরা বামজমানায় উত্তর কলকাতার দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম নেতা লক্ষ্মী দের সঙ্গে সমানে সমানে ‘টক্কর’ নিতেন তাপস। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল তৈরি করার কয়েক বছর পর থেকেই তিনি দিদির সঙ্গে। সোমেনের সঙ্গে কাজিয়ায় মমতা কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল তৈরি করেছিলেন। ফলে মমতার সঙ্গে যাওয়া তাঁর পক্ষে স্বাভাবিকই ছিল।
২০১১ সালে ‘পরিবর্তন’-এর ভোটে বরানগরে নির্বাচনে জেতেন তাপস। তার পর থেকে টানা তিন বার ওই কেন্দ্রেই জিতেছেন তিনি। মমতার দ্বিতীয় সরকারে অল্প কিছু দিনের জন্য প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। তবে তৃতীয় সরকারে ফের তাঁকে মন্ত্রিসভার বাইরে চলে যেতে হয়। আপাতত তিনি বিধানসভায় তৃণমূলের উপমুখ্য সচেতক। সেই সঙ্গে দমদম-ব্যারাকপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি। তার আগে কিছু দিনের জন্য সুদীপকে সরিয়ে উত্তর কলকাতা জেলা তৃণমূলের সভাপতি করা হয়েছিল তাপসকে। কিন্তু সেই দায়িত্ব পাওয়ার অল্প কিছু দিনের মধ্যে মমতা প্রকাশ্য কর্মসূচি থেকে বলেছিলেন, ‘‘সুদীপদা চাইছেন সভাপতি হতে। তাই সুদীপদাকে আমি উত্তর কলকাতার সভাপতি পদটা ফিরিয়ে দিচ্ছি।’’
তাপসের হিতৈষীরা বলেন, তাঁর রাজ্য মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তা পাননি। তাপস শিবিরের অনেকে এর পিছনে সুদীপের ‘হাতযশ’ দেখতে পান। যদিও এর কোনও আনুষ্ঠানিক সমর্থন কখনও মেলেনি।
তাপসের পুত্র-কন্যা দু’জনেই উচ্চশিক্ষিত। তাঁরা বিদেশে কর্মরত। তিনি নিজে নিজেকে ‘ঠোঁটকাটা’ বলেই বর্ণনা করতে পছন্দ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে কখনও দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কোনও অভিযোগ না-ওঠায় একটা প্রচ্ছন্ন গর্বও যে ছিল না, তা নয়। শুক্রবার সেই গর্ব খানিকটা খর্বই হল বোধহয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy