বৃহস্পতিবার অর্পিতাকে নিয়ে যাবতীয় প্রশ্নের জবাবে পার্থ ফিরিয়ে দিয়েছেন নীরবতা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মঙ্গলবার রং ছিল নীল। বৃহস্পতিবার হয়েছে সবুজ। পাঞ্জাবির রঙের মতোই ৪৮ ঘণ্টার ফারাকে বদলে গিয়েছেন তিনি। মঙ্গলবার ভার্চুয়াল শুনানিতে যে ‘চিরসবুজ’ পার্থকে দেখা গিয়েছিল, বৃহস্পতিবার প্রকাশ্যে তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেল না! আদালতে এলেন, গেলেন। কিন্তু ‘প্রেমিক পার্থ’ ধরা দিলেন না। তফাত ছিল আরও— মঙ্গলবার তাঁর সঙ্গে ভার্চুয়াল শুনানিতে হাজির ছিলেন ‘ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার তিনি নেই। যেমন ‘নেই’ ৪৮ ঘণ্টার আগের পার্থও।
বৃহস্পতিবার অর্পিতাকে নিয়ে যাবতীয় প্রশ্নের জবাবে পার্থ ফিরিয়ে দিয়েছেন নীরবতা। সে নীরবতা হিরন্ময়। সে মৌনী সম্মতির লক্ষণ কি না, পার্থই জানেন। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, মঙ্গলবারের পার্থ আর নেই। অন্তত সর্বসমক্ষে।
বৃহস্পতিবারের পার্থকে দেখে অনেক আইনজীবী বলেছেন, সে দিন যা হয়ে গিয়েছে, হয়ে গিয়েছে। ‘ঘনিষ্ঠতা’ অনেকে দেখে ফেলেছেন, সবাই জেনে ফেলেছেন। সেটা ঠিকই আছে। কিন্তু তদন্তের খাতায়কলমে তিনি তো ‘তেমন ভাবে’ অর্পিতাকে চেনেনই না! আইনজীবীরা মনে করাচ্ছেন গত বছরের অগস্ট মাসের কথা। নিয়োগ কেলেঙ্কারির তদন্তে গ্রেফতারের পর পার্থ-অর্পিতাকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরার কথা জানা গিয়েছিল ইডি সূত্রে। ৫ অগস্ট ইডি পার্থকে প্রশ্ন করে, তিনি অর্পিতাকে চেনেন কি না। জবাবে পার্থ জানিয়েছিলেন, না, ‘তেমন ভাবে’ চেনেন না। তা হলে কী ভাবে চেনেন? ইডির পাল্টা প্রশ্নে পার্থ জানিয়েছিলেন, অনেকেই আসেন তাঁর কাছে। তা-ই দেখেছেন। নাকতলার পুজোতেও দেখেছেন। পার্থকে তার পরেও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, অর্পিতার ফ্ল্যাট থেকে বিপুল টাকা উদ্ধারের কথা তিনি জানেন? পার্থ বলেছিলেন, শুনেছেন। তবে ওই টাকা তাঁর নয়।
অর্পিতা অবশ্য নিজের বয়ানে উল্টোটাই জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তাঁর ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হওয়া টাকা এবং অলঙ্কার পার্থের। ওই সম্পত্তিতে তাঁর কোনও অধিকারই ছিল না! তবে তাঁরা যে ‘ঘনিষ্ঠ’, এমন কথা অর্পিতাও নাকি কোনও ভাবেই স্বীকার করেননি।
কিন্তু মঙ্গলের ফ্রেম গোলমাল করে দিয়েছে সব। ভার্চুয়াল শুনানিতে চোখে চোখে কথা, ইশারায় পরস্পরের কুশল জানতে চাওয়া, এমনকি পার্থের হাতের মুদ্রায় ‘লভ সাইন’ দেখানো দেখে ফেলেছেন অনেকে। তা নিয়ে জল্পনা আর আলোচনাও হয়েছে বিস্তর।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মঙ্গলবারও ভার্চুয়াল শুনানিতে প্রথমে পার্থ নীরবই ছিলেন। কিন্তু যখন অন্য স্ক্রিনে অর্পিতাকে দেখেছিলেন, তখন চোখমুখ আলোয় ভরে গিয়েছিল তাঁর। ইশারায় কথা শুরু হয়ে যায়। প্রাক্তন মন্ত্রীর হাতের মুদ্রায় বুকের কাছে দেখা যায় প্রেমের হৃদয়চিহ্ন। কিন্তু বৃহস্পতিবারের মামলার শুনানিতে অর্পিতার ডাক পাওয়ার কথা নয়। তাই পার্থ একাই হাজির। সশরীরে। মঙ্গলে তাঁর চোখের সামনে ছিল অর্পিতার চাউনি, হাসিতে গড়িয়ে পড়া মুখ, চুল গুছিয়ে নেওয়া, ইশারায় অনুরাগ, ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়ানো দুষ্টুমি। তার জবাবে পার্থের তরফে ভাললাগা, কুশল জানানো, চা-পানের তৃপ্তিপ্রকাশ, জিভ ভ্যাঙানোর খুনসুটি।
বিপদ সেখানেই। প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে ধরা পড়ে গিয়েছেন পার্থ-অর্পিতা। যাঁরা পরস্পরকে ‘তেমন ভাবে’ চেনেন না, তাঁরা কী ভাবে হাতের মুদ্রায়, চোখের ইশারায় এত বিনিময় করতে পারেন! ইতিমধ্যেই এমন আলোচনা শুরু হয়েছে যে, সে দিনের ‘আলাপ’ তদন্তকারীদের হাতে নতুন অস্ত্র এনে দিয়েছে। ইতিমধ্যেই পার্থ-অর্পিতার (যাঁরা ইদানীং ‘অপা’ পরিচয়েই বেশি খ্যাত) একাধিক যৌথ সংস্থা এবং সম্পত্তির হদিস পেয়েছে ইডি। পার্থই যে অর্পিতার অনেকগুলি জীবনবিমার ‘নমিনি’, সেই নথিও তদন্তকারীরা জোগাড় করেছেন বলে খবর। ফলে মঙ্গলের খুনসুটি ‘অপা’র পক্ষে অমঙ্গলের হতে পারে বলেও অনেকের অনুমান।
২০২২ সালের জুলাই মাসে গ্রেফতার হয়েছিলেন পার্থ-অর্পিতা। কেটে গিয়েছে সাত মাস। পার্থের জীবনে অনেক বদল এসেছে। মন্ত্রিত্ব গিয়েছে। দলের সমস্ত পদও গিয়েছে। এখন তিনি শুধুমাত্র একজন বিধায়ক। চেহারাতেও এসেছে বদল। তবে রাজনৈতিক সত্তায় যে বদল আসেনি, প্রাক্তন মন্ত্রী তা বুঝিয়ে দিয়েছেন বৃহস্পতিবার। অর্পিতা-প্রশ্নে মুখ না খুললেও তার ফাঁকে বলে দিয়েছেন, ‘‘তৃণমূলে ছিলাম। আছি। থাকব।’’
ঠিকই। পার্থ রাজনীতিক তো বটেই, একদা ম্যানেজমেন্ট পেশাদারও। ফলে তিনি ধরা দিয়েও ধরা দিতে চান না। তাই বৃহস্পতিবার অন্য পার্থকে দেখল আদালতের আঙিনা। যিনি অর্পিতার বিষয়ে প্রশ্নে সত্যি সত্যিই মূক-বধির।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy