ঘটনাপ্রবাহ বলছে, ভাষাযুদ্ধে তৃণমূল-শুভাপ্রসন্নের দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। ফাইল চিত্র।
প্রবীণ চিত্রকর শুভাপ্রসন্ন তাঁদের সম্পর্কে যে ‘অপমানজনক’ ভাষা ব্যবহার করেছেন, তাতে ক্ষুব্ধ তৃণমূলপন্থী দুই প্রবীণ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি এবং সুবোধ সরকার। তাঁরা এ বিষয়ে মুখ না খুললেও বর্ষীয়ান প্রাবন্ধিক এবং প্রবীণ কবি ইতিমধ্যেই বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানিয়েছেন বলে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর। তবে মমতা ওই বিষয়ে কী বলেছেন, তা জানা যায়নি।
গত মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শুভাপ্রসন্নের বক্তব্যে ‘অপ্রসন্ন’ মমতা সঙ্গে সঙ্গেই নিজের ভিন্নমত জানিয়ে দিয়েছিলেন। শুভাপ্রসন্ন তাঁর ভাষণে বাংলা ভাষায় ‘পানি’ বা ‘দাওয়াত’-এর মতো শব্দের অনুপ্রবেশ নিয়ে তাঁর উদ্বেগ এবং অনুযোগের কথা বলেছিলেন। মঞ্চ থেকে শুভাপ্রসন্নকে ‘শ্রদ্ধা’ জানিয়েও মমতা বলেন, তিনি প্রবীণ শিল্পীর সঙ্গে একমত নন। ভাষার প্রবেশেই ভাষার ভান্ডার বৃদ্ধি হয়। তার অব্যবহিত পরে মুখ্যমন্ত্রী বা তৃণমূল এ নিয়ে কোনও কথা বলেনি। কিন্তু পর দিন, বুধবার আনন্দবাজার অনলাইনের প্রশ্নের জবাবে ‘পানি’ ও ‘দাওয়াত’ শব্দ প্রসঙ্গে অনড় ছিলেন শুভাপ্রসন্ন। তিনি এমনও দাবি করেছিলেন যে, মমতার বক্তব্য ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’। কিন্তু তিনিই সঠিক। সেই সূত্রেই মঙ্গলবার তাঁর সঙ্গে একই মঞ্চে থাকা কবি সুবোধ এবং প্রাবন্ধিক নৃসিংহপ্রসাদকে ‘তেলবাজ’ বলে আক্রমণ করেন শুভাপ্রসন্ন। তৃণমূল সূত্রে খবর, প্রকাশ্যে কিছু না-বললেও এমন ‘অপমানজনক শব্দ’ ব্যবহারে তাঁরা যে ক্ষুণ্ণ, তা জানিয়ে ইতিমধ্যেই দু’জন মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার থেকে বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে তৃণমূলের মুখপাত্র এবং সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের মন্তব্য। মমতার বক্তব্যকে ‘রাজনৈতিক’ বলে প্রমাণ করার চেষ্টার বিরোধিতা করে কুণাল বলেন, “একটা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে শুভাপ্রসন্ন একটু বাড়াবাড়ি করছেন। ভাষা দিবসের ঘটনা নিয়ে নতুন করে মমতা’দিকে ভুল প্রমাণ করতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দলের কারও উচিত ওঁর সঙ্গে কথা বলা।’’ এখানেই না থেমে কুণাল শুভাপ্রসন্নকে কটাক্ষ করে বলেন, ‘‘জমি না কমিটির পদ লাগবে, এটা জেনে নিলেই ঝামেলা মিটে যাবে!” যার জবাবে শুভাপ্রসন্ন বলেন, “যাঁদের নিজেদের নানা রকম চাহিদা বা অভাব, তাঁরাই এমন বলে বেড়ান।”
ঘটনা সেখানেই শেষ হয়নি। তৃণমূল সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবারেই শুভাপ্রসন্নের সঙ্গে কুণালের দীর্ঘ কথা হয়। সেই কথার সময়ে পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে যায় যে, একটা সময়ে তা শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করে যায়। কুণাল ‘অপশব্দ’ প্রয়োগ করেন বলেও অভিযোগ। সেই ব্যাপারে শুক্রবার কুণালকে প্রশ্ন করা হলে তিনি তা মেনে নিয়েই আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘শুভা’দা আমার চেয়ে বয়সে বড়। উত্তেজনার বশে আমি কিছু কথা বলে ফেলেছি। যেটা হয়তো ঠান্ডা মাথায় বলতাম না। আমার হয়তো সেটা বলা উচিত হয়নি।’’ সেই অভিজ্ঞতার কথা স্বীকার করে শুভাপ্রসন্নও বলেন, ‘‘কুণাল আমার ভাইয়ের মতো। ও কিছু কথা বলেছিল, যেটা শুনতে ভাল লাগেনি। রেগে গিয়ে বলেছিল হয়তো। তবে পরে সব মিটমাট হয়ে গিয়েছে।’’ সূত্রের খবর, শুক্রবার সকালেও ফোন করে কুণালের সঙ্গে কথা বলেছেন শুভাপ্রসন্ন।
তবে এখানেই তৃণমূল বনাম শুভাপ্রসন্ন লড়াই থামছে না। বরং বলা যেতে পারে, নতুন করে শুরু হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে শুভাপ্রসন্ন রাজ্য সরকারের থেকে কী কী সুবিধা নিয়েছেন, সে সব কথা এখন জনসমক্ষে আনতে তৎপর তৃণমূলের একটি অংশ। তাঁদের একটাই বক্তব্য— মঞ্চের বিতর্ক মঞ্চে শেষ না করে শুভাপ্রসন্ন কেন মুখ্যমন্ত্রীকে ‘ভুল’ প্রমাণ করতে চাইছেন? কেন ভাষা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ করছেন?
তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতা যেমন শুক্রবার বলেছেন, ‘‘সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় শুভাপ্রসন্ন ছিলেন না। নন্দীগ্রামের ঘটনার সময়েও প্রথম থেকে নয়। নন্দীগ্রামে গুলিচালনার অভিযোগ ওঠার পর কলকাতা শহর হোর্ডিং লাগিয়ে সমর্থনের কথা বলেন।’’ ওই নেতার কথায়, ‘‘শুভাপ্রসন্ন আগে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। বাম জমানায় নিজের স্টুডিও বানানোর জন্য নিউ টাউনে জলের দরে জমিও নিয়েছিলেন। মমতা’দি রেলমন্ত্রী হওয়ার পরে কমিটিতে ঢোকা থেকে রেলকে ছবি বিক্রি করার সুযোগ নিয়েছেন উনি। আর রাজ্যে ‘পরিবর্তন’-এর পর বিভিন্ন সরকারি কমিটিতে জায়গা করে নিয়েছেন। হেরিটেজ কমিটির প্রধানও হয়েছেন।’’ ওই তৃণমূল নেতার আরও অভিযোগ, নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে ‘সুবিধা’ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগে ওঁকে হেরিটেজ কমিটির প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুভাপ্রসন্ন হেরিটেজ ভেঙে বহুতল তৈরির সুবিধা করিয়ে দিচ্ছেন জানার পরেই তাঁকে সরিয়ে ওই পদে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব এবং বর্তমানে মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা অভিজ্ঞ আমলা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে আনা হয়। এরই সঙ্গে সারদাকর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে শুভাপ্রসন্নের সম্পর্ক, নিজের টিভি চ্যানেল বিক্রিতে দুর্নীতি ইত্যাদি অভিযোগও প্রকাশ্যে আনতে তৎপর হচ্ছে তৃণমূল।
তবে শুভাপ্রসন্ন এখনও ‘দাওয়াত’ এবং ‘পানি’ প্রসঙ্গে তাঁর অবস্থানে অনড়। একই সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে তৃণমূল যে সব অভিযোগ তুলছে, তা নিয়েও সরব। তিনি বলেন, ‘‘আমার কারও কাছ থেকে জমি নেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। আমি যথেষ্ট রোজগার করি। আর্টস একর বানানোর জন্য জমি নিজের পকেটের ১৪ কোটি টাকায় কিনেছি। এক নয়া পয়সা কেউ আমায় দেয়নি।’’ একই সঙ্গে তিনি জানান, মমতা রেলমন্ত্রী থাকার সময়ে তিনি রেলের ‘অ্যামিনিটিজ় কমিটি’-র চেয়ারম্যান পদে থাকলেও এবং তাঁর আঁকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি রেল তাদের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করলেও তাঁকে সে বাবদে কোনও টাকাপয়সা দেয়নি। হেরিটেজ কমিটি থেকে তাঁর অপসারণ নিয়ে শুভাপ্রসন্নের জবাব, ‘‘কী কাণ্ড! হেরিটেজ কমিশনের মাথায় সাধারণত দু’টি মেয়াদের বেশি রাখা যায় না। মমতা আমাকে চারটি মেয়াদ রেখেছিলেন। আমি কী করেছি, সেটা খোঁজ নিলেই জানা যাবে।’’
ঘটনাপ্রবাহ বলছে, ভাষাযুদ্ধে তৃণমূল-শুভাপ্রসন্নের দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। ‘পানি’ বনাম ‘জল’ বিতর্ককে ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় বলে মনে করছে তৃণমূল। সেই বিতর্কে জল ঢালার পরিবর্তে শুভাপ্রসন্ন নাগাড়ে ঘি ঢেলে যাওয়াতেই আপত্তি। অতঃপর তৃণমূলও পাল্টা আক্রমণে শুভাপ্রসন্নকে কোণঠাসা করার চেষ্টা শুরু করছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy