Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
West Bengal News

‘তোষণের’ উল্টো স্রোত? তৃণমূলে মুসলিমদের পিছনে ঠেলা হচ্ছে! অভিযোগে তোলপাড় কোচবিহার

জেলা তৃণমূল সূত্রের খবর, পার্থপ্রতিম যখন সাংসদ ছিলেন, তখন তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন সাবিদুল। কিন্তু সেই সাবিদুলই এ বার তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে অভিযোগ করেছেন যে, পার্থপ্রতিম রায় ‘কোনও এক ব্যক্তিগত কারণে একটা সম্প্রদায়কে ছোট চোখে দেখছেন’।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৯ ১৯:২৫
Share: Save:

তোষণের রাজনীতি করছে তৃণমূল— এই অভিযোগ তুলেই ভোটের মরসুমে রাজনৈতিক হাওয়ার বেশ খানিকটা মেরুকরণ ঘটিয়ে দিয়েছিল বিজেপি। সেখানে এ বার উলটপূরাণের কাহিনি। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে পিছনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে মুসলিম নেতাদের— এ বার এমনই অভিযোগে তোলপাড় শুরু হল তৃণমূলের অন্দরে।

তৃণমূলের সংগঠন এত দিন যে গতিতে বা যে ভঙ্গিতে চলত, তা মোটেই পছন্দ নয় তৃণমূলের ইলেকশন ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে আসা প্রশান্ত কিশোরের। কিন্তু দু’দশকের বেশি সময় ধরে যে কাঠামো নিয়ে চলেছে তৃণমূল, তা মাত্র কয়েক মাসে আমূল বদলে ফেলা যে সম্ভব নয়, তাও ভোট-কৌশলীর অজানা নয়। তাই কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখে দলের মধ্যে সমন্বয় আরও বাড়ানোর পরামর্শ দেয় আইপ্যাক (পিকের সংস্থা)। মাস দেড়েক আগে তৃণমূল ভবনে হওয়া এক বৈঠকে নেত্রীও দলকে জানিয়ে দেন যে, প্রত্যেক ব্লক থেকে চার জন কর্মীর নাম নেতৃত্বের কাছে জমা দিতে হবে। নানা কর্মসূচির রূপায়ণ এবং সাংগঠনিক বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে নেতৃত্ব এখন থেকে সরাসরি যোগাযোগ রাখবেন বলেও জানানো হয়। তেমনই এক ‘সমন্বয়কারী তালিকা’ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে কোচবিহার জেলায়। কোচবিহারের প্রাক্তন সাংসদ তথা জেলা তৃণমূলের বর্তমান কার্যনির্বাহী সভাপতি পার্থপ্রতিম রায়ের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ তুলে সাবিদুল রহমান নামে এক তৃণমূল নেতা দাবি করেছেন— মুসলিমদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে নেতৃত্ব থেকে।

পার্থপ্রতিমের লেটারহেডে ছাপানো একটি তালিকা সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে। কোচবিহার জেলা তৃণমূলের কার্যনির্বাহী সভাপতি তথা যুব তৃণমূলের জেলা সভাপতি পার্থপ্রতিম রায়ের সই রয়েছে সে তালিকার নীচে। জেলায় তৃণমূলের যে ১৬টি সাংগঠনিক ব্লক রয়েছে, সেগুলির প্রত্যেকটি থেকে একজন করে নেতার নাম সেই তালিকায় রাখা হয়েছে। তালিকাটি পার্থ পাঠিয়েছেন যুব তৃণমূলের সর্বভারতীয় সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

যে ১৬ জনের নাম ঠাঁই পেয়েছে পার্থপ্রতিমের তালিকায়, তাঁদের মধ্যে ২ জন মুসলিম। বাকি ১৪ জন হিন্দু। এতেই ঘোর আপত্তি সাবিদুল রহমানের। যে নামগুলি দলের নেতৃত্বের কাছে পার্থপ্রতিম পাঠিয়েছেন, সেগুলি আসলে যুব তৃণমূলের সম্ভাব্য ব্লক সভাপতিদের নাম— দাবি কোচবিহার-১ নম্বর ব্লকের ওই তৃণমূল নেতার। সেই দাবির উপরে দাঁড়িয়েই তাঁর প্রশ্ন— জেলায় যুব তৃণমূলের ১৬ জন ব্লক সভাপতির মধ্যে সংখ্যালঘু মুখ মাত্র ২টি কেন?

জেলা তৃণমূল সূত্রের খবর, পার্থপ্রতিম যখন সাংসদ ছিলেন, তখন তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন সাবিদুল। কিন্তু সেই সাবিদুলই এ বার তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে অভিযোগ করেছেন যে, পার্থপ্রতিম রায় ‘কোনও এক ব্যক্তিগত কারণে একটা সম্প্রদায়কে ছোট চোখে দেখছেন’। জেলার ৬টি ব্লক সংখ্যালঘু প্রভাবিত, সুতরাং অন্তত ৪-৫টি ব্লকে মূল দলের এবং শাখা সংগঠনগুলির সভাপতি পদে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতাদেরই বসানো উচিত বলে মনে করেন সাবিদুল রহমান।

হোয়াটসঅ্যাপে পার্থপ্রতিম রায়কে আক্রমণ সাবিদুল রহমানের।

আরও পডু়ন: সুপ্রিম কোর্টে শুনানি শুক্রবার, গ্রেফতারির খাঁড়া ঝুলেই রইল চিদম্বরমের উপর

উচ্চতর নেতৃত্বের কাছে যে অভিযোগ জানিয়েছেন সাবিদুল, সেখানে তিনি লিখেছেন, কোচবিহারের যুব তৃণমূলে ‘মুসলিম হঠাও অভিযান শুরু হল’। তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘আমাদের দলে এ সব ছিল না, আগের কোনও জেলা যুব সভাপতি এ সব করেননি, পার্থবাবু এ সব করছেন, এটা আমাদের কাছে দুঃখের ও বেদনার, তা হলে আমরা সংখ্যালঘুরা যাব কোথায়...।’’ যুব তৃণমূলের জেলা সভাপতি যা করেছেন, তাতে জেলায় দলের ক্ষতি হবে বলে সতর্কবার্তাও দিয়েছেন তিনি।

শুধু পার্থপ্রতিমের নামে অভিযোগ করে যে থেমে গিয়েছেন সাবিদুল, তা কিন্তু নয়। খোদ পার্থকেও হোয়াটসঅ্যাপ করে নিজের মতামত জানিয়েছেন ওই তৃণমূল নেতা। সেই দীর্ঘ বার্তায় সাবিদুল লিখেছেন— শিবেন রায়, রাজীব নারায়ণ, অর্ঘ রায়প্রধান বা রানা বসুরা যখন যুব তৃণমূলের জেলা সভাপতি পদে ছিলেন, তখন তাঁরা ‘মুসলিমদের অধিকারটা’ দিতেন, কিন্তু পার্থ সেই অধিকার কেড়ে নিয়েছেন। এই অভিযোগ তিনি কেন করছেন, সে ব্যাখ্যাও পার্থকে দিয়েছেন সাবিদুল। জেলায় ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোট, সুতরাং ৫-৬টি ব্লক মুসলিমদের দেওয়া উচিত— এমনই সওয়াল করেছেন সাবিদুল। পার্থ এবং তাঁর দলবদলকে ‘মুসলিম হঠাও টিম’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন তিনি। পার্থকে সাবিদুল হোয়াটসঅ্যাপে পরামর্শ দিয়েছেন, ‘‘...পারলে এক বার কাউন্টিং করুন, জেলায় এই মুহূর্তে মুসলিম ক’জন তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে লড়াই করছে, আর হিন্দু ধর্মের ক’জন লড়াই করছে, প্রমাণ করে দিন।’’

আরও পড়ুন: আরসালান নন গাড়ি চালাচ্ছিলেন তাঁর দাদা! নাটকীয় মোড় জাগুয়ার-কাণ্ডে

পার্থপ্রতিম রায়কে সাবিদুল যে হোয়াটসঅ্যাপ করেছেন, তার স্ক্রিনশট হাতে হাতে ঘুরতে শুরু করেছে গত কয়েক দিনে। পার্থর বিরুদ্ধে উচ্চতর নেতৃত্বের কাছে যে অভিযোগ সাবিদুল করেছেন, তার বয়ানও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে তোলপাড় শুরু হয়েছে দলে। জেলা তৃণমূলের প্রাক্তন সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষের অনুগামীরা পার্থকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছেন বলেও স্থানীয় সূত্রের খবর।

পার্থপ্রতিম রায় নিজে কিন্তু বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। বুধবার আনন্দবাজারকে তিনি বলেছেন, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়ায় কী ছড়ানো হয়েছে, তা নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করব না।’’ তবে যে তালিকা তিনি নেতৃত্বকে পাঠিয়েছেন, সেটি সম্ভাব্য যুব সভাপতিদের নামের তালিকা নয় বলেই পার্থর দাবি। সাংগঠনিক সমন্বয়ের জন্য ব্লক স্তরের কিছু নেতার নাম নেতৃত্বের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। কিন্তু দলে যাঁরা পার্থর বিরোধী হিসেবে পরিচিত, তাঁদের পাল্টা প্রশ্ন— সমন্বয়ের জন্য তো প্রতি ব্লক থেকে চার জনের নাম চাওয়া হয়েছিল, ওই তালিকায় প্রতি ব্লক থেকে এক জনের নাম কেন?

প্রশ্ন কিন্তু সাবিদুলকে নিয়েও উঠেছে। হোয়াটসঅ্যাপে যে সব কথা সাবিদুল লিখেছেন বা যে ভাষায় উচ্চতর নেতৃত্বের কাছে পার্থর বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ জানিয়েছেন, জেলা তৃণমূলের অনেকেই তাতে সাম্প্রদায়িক কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছেন। জেলায় কত শতাংশ মুসলিম ভোট, তার ভিত্তিতে হিসেব করলে কতগুলি ব্লকে দলের এবং শাখা সংগঠনের সভাপতি পদে মুসলিমদের বসানো উচিত, তৃণমূলের হয়ে মুসলিমরা লড়ছেন, নাকি হিন্দুরা— এই ধরনের প্রশ্ন তোলাকে মোটেই ভাল চোখে দেখছেন না তৃণমূলেরই অনেকে। রবীন্দ্রনাথ ঘোষের অনুগামী তথা পার্থপ্রতিম রায়ের বিরোধী হিসেবে পরিচিত নুর আলম হোসেনও সমর্থন করছেন না সাবিদুলের তত্ত্বকে। দিনহাটা-১ ব্লক তৃণমূলের প্রাক্তন সভাপতি নুর আলমের কথায়, ‘‘পার্থপ্রতিম রায় কিসের তালিকা পাঠিয়েছেন জানি না। বিষয়টা আমি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে জানতে পেরেছি। তবে কোনও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কেউ কোনও তালিকা তৈরি করেছেন বলে আমার মনে হয় না।’’

সাবিদুল রহমান অবশ্য 'সাম্প্রদায়িকতা’র অভিযোগ নস্যাৎ করছেন। আনন্দবাজারকে তিনি বলেছেন, ‘‘আমি নিজে জাতপাত মানি না। আমি গত ১১ বছর ধরে একটা হিন্দু বাড়িতে থাকি-খাই। আমি যে অভিযোগ করেছি, তা দলের ভাল-মন্দের কথা ভেবেই করেছি এবং তথ্য দিয়ে করেছি’’ তাঁর কথায়, ‘‘আমি দলের পুরনো কর্মী। দল আগে কী ভাবে চলত, সেটা তো দেখেছিই। এখন কী ভাবে চলছে, তা-ও দেখছি। কোন পথে চললে দলের ভাল হবে, আমি জানি। তাই নিজের ক্ষোভের কথাটা জানিয়েছি। এর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার কিছু নেই।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Cooch Behar TMC Partha Pratim Ray
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy