(বাঁ দিকে) রুজিরা নারুলা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং (ডান দিকে) অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
সোমবার সকাল থেকে একের পর এক ঘটনায় নতুন করে উঠে এল সেই পুরনো অভিযোগ। তবে কি কেন্দ্রীয় সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিপাকে ফেলতে চাইছে কেন্দ্রের শাসকদল? তৃণমূলের অভিযোগ, অভিষেকের ‘নবজোয়ার’ কর্মসূচি ভেস্তে দিতেই এই সক্রিয়তা। সোমবার সকালে তাঁর স্ত্রী রুজিরা নারুলা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আটকানো হয় কলকাতা বিমানবন্দরে। বেশ কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও দুবাইগামী বিমান ধরতে পারেননি রুজিরা। অভিবাসন দফতরের কর্তাদের ‘বাধায়’ বিমানবন্দর থেকে পুত্র-কন্যাকে নিয়ে ফিরে আসতে হল তাঁকে।
অভিবাসন দফতর সূত্রের যুক্তি, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর একটি মামলায় ‘লুক আউট’ নোটিস জারি হয়েছে রুজিরার নামে। তাই তাঁর বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। এর পর ইডি সূত্রে জানা গেল, কয়লা পাচার মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রুজিরাকে আগামী বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় তদন্তকারী সংস্থার দফতর, সিজিও কমপ্লেক্সে (কলকাতায় যেখানে ইডির দফতর রয়েছে) ডেকে পাঠানো হয়েছে।
ঘটনাচক্রে, কয়লা পাচার মামলাতেই আগামী ১৯ জুন ইডি তলব করেছে রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটককেও। ঘটনাচক্রে, তিনি ‘অভিষেক-ঘনিষ্ঠ’ বলেই পরিচিত। তবে সিজিও কমপ্লেক্স নয়, তাঁকে দিল্লির ইডি দফতরে হাজির হতে বলা হয়েছে। কয়লা পাচারকাণ্ডে আগেও একাধিক বার মলয়কে তলব করেছে ইডি। তাঁর বাড়িতে গিয়ে তল্লাশি করেছেন সিবিআই আধিকারিকরা। এমনকি, টানা জেরাও করা হয়েছে মন্ত্রীকে। তবে ইডির একাধিক বার তলবেও দিল্লি যাননি মলয়। তবে দিল্লি হাই কোর্টের নির্দেশের পর এ বার মলয় দিল্লি যেতে সম্মত হয়েছেন বলে ইডি সূত্রের খবর।
রুজিরাকাণ্ডের জেরে সোমবার দিনভর সরগরম ছিল রাজ্য রাজনীতি। অভিবাসন দফতরের এই পদক্ষেপে উষ্মা প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। অভিষেকের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রের দাবি, ইডির ওই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট অভিষেক এবং রুজিরাকে রক্ষাকবচ দিয়ে জানিয়েছিল, তাঁদের বিদেশযাত্রার ক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই। তা সত্ত্বেও রুজিরাকে বিমানবন্দরে বাধা দেওয়ায় অভিষেক এ বার আইনি পদক্ষেপ করতে পারেন বলেও এই সূত্রের খবর।
তৃণমূলের তরফে অভিযোগ তোলা হয়েছে, পরিকল্পিত ভাবে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে কাজে লাগিয়ে অভিষেককে হেনস্থা করতে চাইছে বিজেপি। ‘নবজোয়ার’ কর্মসূচিতে আঘাত হানা এর অন্যতম উদ্দেশ্য বলেও দলের অভিযোগ। তৃণমূল নেতাদের একাংশের মতে, শনিবারের ঘটনা প্রমাণ করে দিচ্ছে, অভিবাসন দফতর-ইডির এই ‘সক্রিয়তার’ পিছনে রয়েছে কেন্দ্রের শাসকদল। তাঁদের মতে, বিজেপি যে অভিষেককে ভয় পায়, এই ঘটনাতেই তা স্পষ্ট।
প্রসঙ্গত, রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে ধৃত প্রাক্তন যুব তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষের চিঠি সংক্রান্ত মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত ২০ মে নিজাম প্যালেসে সিবিআই দফতরে তলব করা হয়েছিল অভিষেককে। সিবিআইয়ের নোটিসের কথা জানার পরেই বাঁকুড়ার সোনামুখীতে তৃণমূলের ‘নবজোয়ার’ কর্মসূচি থামিয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন অভিষেক। জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। সে সময় মমতা বলেছিলেন, ‘‘বিজেপি অভিষেককে ভয় পেয়েছে। ওরা নবজোয়ার কর্মসূচিকে থামাতে অভিষেককে ডেকে পাঠিয়েছে।’’
অভিষেক-পত্নীকে বিমানবন্দরে ‘বাধা’
সোমবার সকাল ৭টা নাগাদ কলকাতা বিমানবন্দরে আটকানো হল ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেকের স্ত্রী রুজিরাকে। সূত্রের খবর, ২ সন্তানকে নিয়ে তিনি দুবাইয়ের বিমান ধরার জন্য বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন। বিমান ধরার আগেই তাঁকে ‘বাধা’ দেয় অভিবাসন দফতর। বেশ কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করার পর বিমানবন্দর ছেড়ে বেরিয়ে যান অভিষেক-পত্নী। অভিবাসন দফতর সূত্রের খবর, ইডির একটি মামলায় ‘লুক আউট’ নোটিস জারি হয়েছে রুজিরার নামে। গত সেপ্টেম্বর মাসে অভিষেকের রক্ষাকবচ বহাল রাখে সুপ্রিম কোর্ট। তৃণমূলের ‘সেনাপতি’র বিরুদ্ধে কোনও কড়া পদক্ষেপ করা যাবে না বলেও নির্দেশ দেয় আদালত। তাঁর চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রেও কোনও বাধা নেই বলে জানানো হয়। এই পরিস্থিতিতে রুজিরাকে বিমানবন্দরে বাধা দেওয়ার বিরুদ্ধে অভিষেক আবার আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন বলে তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর।
কয়লা-মামলায় রুজিরাকে বৃহস্পতিতে তলব ইডির
শুধু বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানোই নয়, কয়লা পাচার মামলায় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেকের স্ত্রী রুজিরাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলবও করল ইডি। সোমবার কেন্দ্রীয় সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে, আগামী বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় তাঁকে সিজিও কমপ্লেক্সে (কলকাতায় যেখানে ইডির দফতর রয়েছে) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছে। এর আগে কয়লা পাচার মামলায় অভিষেক ও তাঁর স্ত্রী রুজিরাকে বেশ কয়েক দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ইডি। অতীতে ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল সাংসদ এবং তাঁর স্ত্রীকে দিল্লিতে তলবও করেছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সমন পেয়ে দিল্লিতে ইডির দফতরে হাজিরা দিয়েছিলেন অভিষেক। তবে দিল্লিতে ইডি দফতরে হাজিরা দেননি রুজিরা। পরিবর্তে সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে হাজিরা দিয়েছিলেন তিনি।
কয়লাকাণ্ডে তলব রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয়কেও
কয়লা পাচারকাণ্ডে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটককেও তলব করেছে ইডি। আগামী ১৯ জুন তাঁকে দিল্লির ইডি দফতরে হাজির হতে বলা হয়েছে। ইডি সূত্রে খবর, মলয়কে জিজ্ঞাসাবাদ করার বিষয়ে দিল্লি হাই কোর্ট তদন্তকারী সংস্থাটিকে নির্দেশ দিয়েছিল যে, তলব করার অন্তত ১৫ দিন আগে নোটিস পাঠাতে হবে। সেই মতো হাতে সময় রেখেই তাঁকে ডাকা হয়েছে বলে জানিয়েছে ওই সূত্রটি। আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পরেই তদন্তকারীরা রাজ্যের আইনমন্ত্রীকে মেল করে তাঁর সময় চেয়েছিলেন। কিন্তু ইডির ওই সূত্রটির দাবি, সেই মেলগুলির কোনও উত্তর দেননি মলয়। তৃতীয় বার নিজেই মেল করেন তিনি। সেই মেলে মলয় ওই সময় (১৯ জুন) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ইডিকে সম্মতি দেন।
কয়লা পাচারকাণ্ডের তদন্তে ইডি তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বার বার দিল্লিতে ডেকে পাঠানোয় মলয় দিল্লি হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। ইডি দিল্লি হাই কোর্টে পাল্টা অভিযোগ তুলে জানায়, ৯ বার সমন পাঠানো সত্ত্বেও সাড়া না দিয়ে অপরাধ করেছেন মলয়। দিল্লি হাই কোর্টের বিচারপতি দীনেশকুমার শর্মা এই মামলায় দু’পক্ষের বক্তব্য শুনে জানান, ইডি মলয় ঘটককে দিল্লিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নোটিস পাঠাবে। তবে হাজিরার দিনের ১৫ দিন আগে সমন পাঠাতে হবে। আগে যে সমন পাঠানো হয়েছে, তাতে সাড়া না দেওয়ার প্রেক্ষিতে ইডি কোনও দমনমূলক ব্যবস্থা নেবে না। মলয়ের আইনজীবীরা যুক্তি দিয়েছিলেন, রাজ্যের আইনমন্ত্রী হওয়ার জন্য মলয় প্রবল ব্যস্ত থাকেন। বিচারপতি শর্মা ইডিকে মলয়ের ব্যস্ত কর্মসূচির দিকটি মাথায় রাখতে বলেন। একই সঙ্গে মলয়কে দিল্লিতে এসে তদন্তে সহযোগিতা করার কথাও বলেন। মলয়ের আইনজীবীরা মন্ত্রীকে কলকাতাতেই জিজ্ঞাসাবাদ করার আর্জি জানিয়েছিলেন। এই আর্জির বিষয়টি অবশ্য এখনও দিল্লি হাই কোর্টে বিচারাধীন। এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর এই কয়লা পাচার মামলাতেই মলয়ের সরকারি বাসভবন-সহ একাধিক বাড়ি এবং অন্যান্য জায়গায় তল্লাশি চালিয়েছিল আর এক তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই।
‘ইডিকে জানিয়েই বিদেশ যাচ্ছিলেন রুজিরা’, বললেন মমতা
বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে তদন্তকারী সংস্থা ইডিকে জানিয়েছিলেন অভিষেকের স্ত্রী রুজিরা। সোমবার এমনটাই জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় মৃত ৪ জনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী দ্বিতীয় হুগলি সেতুর টোল প্লাজা থেকে জানান, দুর্ঘটনায় আহতদের দেখতে মঙ্গলবার তিনি ওড়িশার কটক এবং ভুবনেশ্বরে যাবেন। সেখানেই সংবাদমাধ্যমের তরফে তাঁকে অভিষেক-পত্নীকে বিমানবন্দরে আটকানো নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী তখন রুজিরার বিদেশযাত্রার কারণ জানিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘মানবিকতা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
সোমবার এই সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে ‘ওরা ভাল বলতে পারবে’ জানিয়েও মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ও (রুজিরা) একটা পঞ্জাবি মেয়ে। ওর মা খুব অসুস্থ।” তার পরেই শীর্ষ আদালতের নির্দেশের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মমতা বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি দেওয়া ছিল। যদি ও কখনও বাইরে যায়, তবে ইডিকে জানাবে। সেই অনুযায়ী ও (রুজিরা) ইডিকে জানিয়েছে অনেক দিন আগেই। তখন ইডি বলতে পারত, তুমি যেও না।” ইডির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কিন্তু বিমানবন্দরে গিয়ে নোটিস ধরানো হাতে, যে ৮ তারিখে তুমি এসো... অমানবিক জিনিস চলছে।”
অভিষেকের ‘জবাব’ শুভেন্দুকে
কলকাতা বিমানবন্দর থেকে রুজিরাকে ফেরত পাঠানোর ঘটনা নিয়ে সোমবার সন্ধ্যায় অভিষেককে নিশানা করেছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। অতীতে রুজিরা বেআইনি ভাবে কলকাতা বিমানবন্দরে বিদেশ থেকে সোনা এসেছিলেন বলেও অভিযোগ করে তিনি। রাতে অভিষেক বলেন, ‘‘আমার স্ত্রীকে নাকি সোনা পাচার করতে গিয়ে সিআইএসএফ ধরেছিল। আমি চ্যালেঞ্জ করছি। বিমানবন্দরে ৫০০টি সিসিটিভি রয়েছে। সেগুলি বিধাননগদর পুলিশ কমিশনারেটের অধীনে পড়ে। সিআইএসএফের অধীনে পড়ে। সেগুলি বার করুন।’’ ২ কিলো সোনা দূর, বলছে ২ গ্রাম সোনাও রুজিরার কাছ থেকে কখনও বাজেয়াপ্ত হয়নি বলে দাবি করেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।
সেই সঙ্গে বিদেশযাত্রা প্রসঙ্গে অভিষেক বলেন, ‘‘সেপ্টেম্বরে চোখের চিকিৎসা করাতে আমি গিয়েছিলাম। আমার স্ত্রীও গিয়েছিল। তখন তো আটকায়নি। এখন তৃণমূলে নবজোয়ার চলছে বলে কী ভাবে অভিষেককে মানসিক ভাবে হেনস্থা করা যায়? আমি অন্য ধাতুতে তৈরি। তোমার মতো মেরুদণ্ড বিক্রি করে লড়াই করি না। আমি নরেন্দ্র মোদীকে সম্মান জানিয়ে বলছি, দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সম্মান জানিয়ে বলছি, আপনি মানুষের দরবারে এসে আমার সঙ্গে লড়াই করুন। আমার সঙ্গে লড়াইয়ে না পেরে আমার স্ত্রী, বাচ্চাদের টার্গেট করছেন। ৩ বছরের ছেলে, ৯ বছরের মেয়ে। তাদেরও ছাড়ছেন না। পরিবারকে টার্গেট করেল মাথানত করব না, গলা কাটলেও মাথানত করব না। আপনাকে উৎখাত করে ছাড়ব বলেছি, বাংলার মানুষ আগামী দিন প্রমাণ করবে। যত সময় লাগুক, প্রাণ দিয়ে, রক্ত দিয়ে খাটতে রাজি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy