ফের বিতর্কে বিধায়ক দীপালি সাহা।
যে অভিযোগ তুলে পুরভোটের পরের দিনই থানায় ঢুকে হম্বিতম্বি করেছিলেন শাসক দলের দাপুটে নেত্রী, সেই অভিযোগ খারিজ করে দিলেন অভিযোগকারী তৃণমূল প্রার্থী নিজেই! আর তার জেরে ফের বিতর্কে সোনামুখীর তৃণমূল বিধায়ক দীপালি সাহা।
দশ বছর পরে এ বার সোনামুখী পুরসভার ক্ষমতা সিপিএম তথা বামফ্রন্টের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে তৃণমূল। খুব শীঘ্রই পুরবোর্ড তৈরি হবে। সোনামুখীতে এমনিতেই তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রবল। দীপালিদেবী নিজে পুরপ্রধান হবেন নাকি তাঁর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর কেউ, তা নিয়ে দড়ি টানাটানিও চলছে। এই অবস্থায় সোনামুখীর ৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী শিপ্রা ধীবর সোমবার এবিপি-আনন্দ’র কাছে দাবি করেছেন, পুরভোটের দিন তাঁর স্বামীকে মারধর করা হয়েছে, এই মর্মে সিপিএমের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তিনি থানায় দায়ের করেছিলেন, তা ঠিক নয়। তাঁকে দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়েছিলেন দলেরই লোকজন। আদালতে গিয়ে তাঁরা অভিযোগ প্রত্যাহারের কথা ভাবছেন বলেও জানিয়েছেন ওই প্রার্থীর স্বামী সমীর ধীবর।
ঘটনা হল, মারধরে অভিযুক্ত সিপিএম নেতা-সহ সাত জন পুলিশি গ্রেফতারির ভয়ে আপাতত ঘরছাড়া। সিপিএম নেতৃত্ব এখন বলছেন, দীপালিদেবীই ভয় দেখিয়ে ওই তৃণমূল প্রার্থীকে দিয়ে তাঁদের নেতা-কর্মীদের নামে মিথ্যা অভিযোগ করিয়েছেন। পুরবোর্ড গঠনের মুখে এই ঘটনা অস্বস্তিতে ফেলেছে বাঁকুড়া জেলা তৃণমূল নেতৃত্বকে। গত লোকসভা ভোটে এই দীপালিদেবীর বিরুদ্ধেই সোনামুখীর একটি বুথে ঢুকে প্রিসাইডিং অফিসারকে মারধর করে ছাপ্পা ভোট দেওয়ার অভিযোগে রাজ্য রাজনীতিতে তুমুল হইচই হয়েছিল। বিধায়কের বিরুদ্ধে একাধিক জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু হলেও পুলিশ তাঁকে ধরার সাহস করেনি। শেষ অবধি আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পান দীপালিদেবী। তাঁর হয়ে জামিনের আবেদন করেন সোনামুখীর পাশের পুর-শহর বিষ্ণুপুরের বিধায়ক তথা রাজ্যের বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
রাঢ়বঙ্গে একমাত্র বাঁকুড়া জেলার সোনামুখী পুরসভাই বামেদের দখলে ছিল। এ বার ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে তৃণমূল। এ বার তাই পুরভোটে প্রথম থেকেই তৃণমূল-সিপিএম চাপানউতোরে তেতে ছিল সোনামুখী। দীপালিদেবী-সহ স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বহিরাগত এনে সন্ত্রাস চালানোর অভিযোগ করেছিল বাম শিবির। বিশেষ করে উত্তেজনা ছিল ৮ নম্বর ওয়ার্ডে। ভোটের ঠিক আগের দিন বাম কর্মী-সমর্থকরা ওই এলাকারই এক তৃণমূল কর্মীর বাড়ি থেকে ৩৭ জন বহিরাগতকে হাতেনাতে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেন। গোটা ঘটনায় নেতৃত্বে ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা তথা সিপিএমের সোনামুখী জোনাল কমিটির সদস্য সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়। ভোটের পরের দিনই থানায় দীপালিদেবীর নেতৃত্বে বিক্ষোভ দেখান তৃণমূলের কর্মীরা। থানায় ঢুকে তৃণমূল বিধায়ক পুলিশকর্মীদের শাসানি দেন বলেও অভিযোগ।
থানার এক এএসআইয়ের বিরুদ্ধে এক তৃণমূল কর্মীকে ভোটের দিন লাঠিপেটা করার অভিযোগও দায়ের হয়।
পাশাপাশি সঞ্জয়বাবু-সহ সিপিএমের সাত জনের নামে সমীর ধীবরকে মারধরের একটি অভিযোগও দায়ের হয়। যাতে সই ছিল শিপ্রাদেবীর। শুধু তাই নয়, সঞ্জয়বাবুকে ‘আধ ঘণ্টা’র মধ্যে গ্রেফতারের দাবি তোলে তৃণমূল। বিধায়কের চাপে এ দিনই ওই সিপিএম নেতার খোঁজে এলাকায় যায় পুলিশ। কিন্তু, এলাকার ছেলেকে ফাঁসানো হচ্ছে অভিযোগ তুলে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কয়েকশো বাসিন্দা এবং বাম কর্মী প্রতিবাদ মিছিল শুরু করে থানায় যান। পুলিশ তখনকার মতো চুপচাপ থাকলেও তার পর থেকে অভিযুক্তদের খোঁজে একাধিকবার এলাকায় হানা দিয়েছে বলে সিপিএমের দাবি। তখন থেকেই সঞ্জয়বাবুরা এলাকা ছাড়া।
ওই ওয়ার্ডে সিপিএম প্রার্থী রুমা সরকারের কাছে ৭৭৩ ভোটে হেরে যাওয়া শিপ্রাদেবী এ দিন অবশ্য সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘আমার স্বামীকে সিপিএমের কেউ মারধর করেনি। ওটা ছিল মিথ্যে অভিযোগ!’’ পাল্টা তৃণমূল কর্মীদের বিরুদ্ধেই সাদা কাগজে সই করিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন তিনি। তাঁর স্বামী সমীরবাবুর দাবি, ভোটের দিন সকালে বুথ থেকে ফেরার পথে তাঁকে কিছু লোক মারধর করে। সঞ্জয়বাবু কি ছিলেন? সমীরবাবুর জবাব, ‘‘আমি জানি না। দেখিনি।’’ তা হলে তাঁর নামে অভিযোগ হল কেন? সমীরবাবুর দাবি, তাঁর স্ত্রীকে দিয়ে দলেরই কিছু লোক সই করিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তার পরে কী অভিযোগ হয়েছিল, তা তাঁরা জানেন না। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমার এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাননি। তবে, জেলার এক পুলিশ কর্তা বলেন, ‘‘ওঁরা পুলিশকে লিখিত ভাবে কিছু জানাননি। তাই ওই মারধরের ঘটনার তদন্ত যেমন চলছিল, তেমনই চলবে। ওঁরা চাইলে আদালতে গিয়ে মামলা প্রত্যাহার করে নিতে পারেন।’’ বিষ্ণুপুর আদালতে ওই মামলা চলছে।
মামলা প্রত্যাহার কি করবেন? সমীরবাবু এখন বলছেন, ‘‘আমরা সে কথা ভেবেছি। তবে, তা করার আগে দলের নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলব।’’ নেতৃত্ব বলতে কি দীপালিদেবী? উত্তর এল, ‘‘তা বলতে পারব না!’’
সোনামুখীর বাসিন্দা, সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য শেখর ভট্টাচার্য বলেন, “দীপালি কথায় কথায় মিথ্যে কথা বলেন, এর চেয়ে বড় প্রমাণ কী হতে পারে? উনি-ই যে আমাদের কর্মীদের নামে মিথ্যা অভিযোগ করিয়েছিলেন, তা তৃণমূল প্রার্থীর বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট।” মুখ খুলতে রাজি হননি এলাকায় দীপালিদেবীর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর নেতা হিসাবে পরিচিত সুরজিৎ মুখোপাধ্যায়। বিধায়কের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘সঞ্জয় ভয় দেখাচ্ছে বলেই এখন এমন কথা বলেছে শিপ্রা। মারধরের কথা স্বামী-স্ত্রী, দু’জনেই আমাদের বলেছিল। তার ভিত্তিতেই অভিযোগ হয়েছে।’’
এ কথা শুনে সিপিএম নেতা সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় এ দিন ফোনে বললেন, “আমি ও আমার সহকর্মীরা এখনও ঘরছাড়া। এই অবস্থায় কাউকে ভয় দেখানো কি সম্ভব? ফের মিথ্যের আশ্রয় নিচ্ছেন দীপালিদেবী।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy