পথ দেখাতে চাইলেন মদন। কিন্তু দেখলেনই না মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার নিউ টাউনে নতুন সরকারি বাসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ছবিটি তুলেছেন সুদীপ্ত ভৌমিক।
সিবিআই-এর সারদা তদন্তে এ বার খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হতেই আত্মরক্ষায় মরিয়া তৃণমূল আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল। যে মুখ্যমন্ত্রী দু’দিন আগে সারদা তদন্তে সিবিআই-কে যাবতীয় সহযোগিতার কথা বলেছেন, তাঁর দলের শীর্ষ নেতারাই এখন সিবিআই-এর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন! তাঁদের অভিযোগ, সিবিআই তদন্তের লক্ষ্য এখন কার্যত সারদার ‘স্বার্থরক্ষা’!
মমতা রেলমন্ত্রী থাকাকালীন রেলের অধীনস্থ সংস্থা ‘ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ক্যাটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম কর্পোরেশন’ (আইআরসিটিসি)-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে পর্যটন ব্যবসায় নেমেছিল সুদীপ্ত সেনের ‘সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলস’ সংস্থা। সে সময়ে রেল বোর্ডের এক সদস্যের সামনে উভয় পক্ষের মধ্যে ওই চুক্তি হয়েছিল। সূত্রের খবর, রেল ও সারদা সংস্থার মধ্যে ওই চুক্তি সম্পাদনে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতার এক ঘনিষ্ঠ আমলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। রেল সূত্রের খবর, ওই অফিসার রেলমন্ত্রীর দফতরে উঁচু পদে আসীন ছিলেন। পরে মমতা মুখ্যমন্ত্রী হলে তিনি কলকাতা ফিরে যান। শুধু সারদা নয়, নিয়মের তোয়াক্কা না-করেই উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু ট্রেনের একাধিক কামরা একটি বেসরকারি পর্যটন সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে ওই অফিসারের বিরুদ্ধে। ফলে ওই আমলার ভূমিকা-সহ মমতা রেলমন্ত্রী থাকাকালীন সারদা সংক্রান্ত সমস্ত লেনদেন খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিবিআই।
পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে, ওই চুক্তির বিষয়ে মমতা কি সত্যিই কিছু জানতেন না? নাকি জেনেও চোখ বন্ধ করে ছিলেন? রেল বলছে, সাধারণত নিয়ম হল এ ধরনের চুক্তি হলে রেলমন্ত্রীকে তা বিস্তারিত ভাবে জানিয়ে থাকেন রেলকর্তারা। তাই মমতা সারদা সংস্থার বিষয়ে কিছুই জানতেন না, এটা ধরে নেওয়া ঠিক নয় বলেই জানাচ্ছেন বর্তমান রেলকর্তারা। বিশেষত, মমতার আমলেই রেলে বেসরকারি সংস্থাদের সঙ্গে যৌথ প্রকল্পের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। মমতা নিজেই এ ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিলেন।
দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমলে ২০০৯ সালে রেলমন্ত্রী হন মমতা। প্রায় দু’বছর ওই পদে ছিলেন তিনি। ২০১১ সালে রাজ্যে বামেদের হটিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। তার দেড় বছরের মাথায় সারদা কেলেঙ্কারি সামনে আসে। সে সময়ে মমতা দাবি করেছিলেন, তিনি সারদা গোষ্ঠী এবং ওই সংস্থার প্রধান সুদীপ্ত সেনের কার্যকলাপ সম্পর্কে আগে থেকে কিছুই জানতেন না। কিন্তু সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে সিবিআই জানতে পেরেছে, বাস্তব বলছে অন্য কথা।
এই অবস্থায় সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা ও তাঁর দফতরের ভূমিকাও নতুন করে খতিয়ে দেখার বিষয়ে ভাবছেন সিবিআই কর্তারা। সে সময়ে যে আমলারা মমতার ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁদের ভূমিকাও এ বার তদন্তের আওতায় আসতে চলেছে বলে সিবিআই সূত্রের খবর। সোমবার রেল মন্ত্রক সূত্রে দাবি করা হয়েছে, এ বিষয়ে সিবিআই যে তথ্যপ্রমাণ চাইবে, তা দিয়ে তাদের সাহায্য করা হবে। সোমবার দুপুরে কলকাতায় রেল প্রতিমন্ত্রী মনোজ সিংহকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “সিবিআই যখন তদন্ত করছে, তখন রেলের আর আলাদা করে তদন্ত করার প্রয়োজন নেই। কেউ দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি হবে।” সাংবাদিকরা জানান, ওই সময় রেলমন্ত্রী ছিলেন মমতা। উত্তরে তিনি বলেন, “আমি কারও নাম বলছি না। তবে তিনি যিনিই হোন না কেন, আইন আইনের পথেই চলবে।” বিষয়টি নিয়ে মুখ বন্ধ রেখেছেন আইআরসিটিসি কর্তৃপক্ষ। সংস্থার মুখপাত্র থেকে তৎকালীন এমডি রাকেশ টন্ডন সকলেরই মোবাইল দিনভর সুইচড অফ ছিল। বন্ধ ছিল আইআরসিটিসি পূর্বাঞ্চলের তৎকালীন গ্রুপ জেনারেল ম্যানেজারের ফোনটিও। বিষয়টি যে হেতু আইআরসিটিসি-র এক্তিয়ারভুক্ত, তাই এ বিষয়ে সরাসরি কোনও মন্তব্য করতে চাননি রেল কর্তৃপক্ষ।
তবে মমতার দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ও প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মুকুল রায় বলেন, “এত দিন জানতাম, যাঁরা সারদায় প্রতারিত হয়েছেন, সিবিআই তাঁদের জন্য তদন্ত করছে। সব দেখেশুনে এখন মনে হচ্ছে, যারা সারদাকে প্রতারিত করেছে, সিবিআই তদন্ত করছে তাদের চিহ্নিত করতে।” তাঁর এই মন্তব্যের কোনও ব্যাখ্যা মুকুলবাবু দেননি। তবে তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, সুদীপ্ত সেন প্রতারণা করেননি, বরং প্রতারিত হয়েছেন, জনমানসে এমন একটা ধারণা তৈরি করার চেষ্টা চলেছে। মুকুলবাবু তার বিরুদ্ধেই মুখ খুলেছেন। তবে সিবিআই সূত্রে বলা হচ্ছে, সুদীপ্তকে প্রতারণা করতে কারা সাহায্য করেছেন, সেটা খুঁজে বার করাও তাদের কাজ। সুপ্রিম কোর্টও সারদা কেলেঙ্কারিতে যুক্ত প্রভাবশালীদের খুঁজে বের করতেই বলেছে।
১৯৯৮ সালে রেলে ক্যাটারিং নীতি তৈরি হওয়ার পরে দূরপাল্লার ট্রেনে খাবার পরিবেশনের দায়িত্ব পায় আইআরসিটিসি। কিন্তু তাদের খাবারের মান নিয়ে অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকে। মমতা রেলমন্ত্রী হওয়ার পর খাবার পরিবেশনের দায়িত্ব নিজেদের হাতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রেল। ঠিক হয় আইআরসিটিসি-র মূল আয় হবে পর্যটন সংক্রান্ত প্যাকেজ বিক্রি করে। রেলের মাধ্যমে পর্যটনকে উৎসাহিত করতে মমতা বাজেটে ‘ভারত তীর্থ’ নামের বিশেষ প্রকল্পও ঘোষণা করেন।
মমতার পরিকল্পনা ছিল, হাওড়া থেকে যাত্রীদের নিয়ে এই ট্রেন যাবে মথুরা, গয়া, জয়পুর, রামেশ্বরম, কাঞ্চিপুরম এবং মাদুরাই। রেলের মাধ্যমে দক্ষিণ ভারতের তীর্থ ভ্রমণে জোর দেন তিনি। সে কথা মাথায় রেখে ওই বছর রেল বাজেটে হাওড়া থেকে পুদুচেরি পর্যন্ত ট্রেনের ঘোষণা করা হয়েছিল। রেল সূত্রের খবর, দক্ষিণমুখী ‘ভারত তীর্থ’ ট্রেন চালানোর জন্য আইআরসিটিসি-র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় ‘সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলস’।
বর্তমানে গোটা দেশে একাধিক এই ধরনের ট্রেন চালু রয়েছে। রেল বলছে, এই ধরনের ট্যুরের মাধ্যমে ভাল লাভ করে সংশ্লিষ্ট পর্যটন সংস্থাগুলি। ফলে বহু সংস্থাই রেলের সঙ্গে এই ব্যবসা করতে আগ্রহী। সংস্থা বাছতে প্রথমে দরপত্র ডাকা হয়। নিয়ম হল, যে সব সংস্থা দরপত্রে অংশ নেবে, তাদের বাজারে সংশ্লিষ্ট কাজের ন্যূনতম যোগ্যতা এবং ব্র্যান্ড ইমেজ থাকতে হবে। ‘সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলস’ রেলকে জানায়, তারা ২০০৭ থেকে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু সেই দাবি কতটা সত্য, তা খতিয়ে দেখেননি তৎকালীন রেল কর্তারা। কার্যত ভুঁইফোঁড় একটি সংস্থাকে কী ভাবে ওই ধরনের ট্যুর করার অনুমতি দেওয়া হল, তা নিয়ে প্রশ্ন রেলের অন্দরমহলেই। রেল কর্তাদের একাংশের দাবি, সুপারিশ ছাড়া এটা হওয়া অসম্ভব। আর সেই সুপারিশ আসতে হবে শীর্ষ মহল থেকে। সামগ্রিক চুক্তিপত্রে এ নিয়ে রেলমন্ত্রীর দফতরের কোনও লিখিত বক্তব্য রয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিবিআই।
মুকুল বলেন, “একটি সংস্থার কাছ থেকে আর একটি সংস্থা বরাত পেয়েছে। তাতে কী হল!” এক প্রাক্তন রেল প্রতিমন্ত্রী ও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর দাবি, “সারদা-কর্তা, তৎকালীন রেলমন্ত্রী ও আইআরসিটিসির তৎকালীন প্রধানকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করুক সিবিআই। তা হলেই সত্য উদ্ঘাাটিত হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy