কৈরভীর উপনয়নের কার্ড। ছবি: সৌজন্যে পরিবার।
‘বামুন চিনি পৈতে প্রমাণ, বামনি চিনি কী করে?’ লালনের গানের সেই চিরকালীন প্রশ্নের জবাবই যেন সিউড়ির চিকিৎসক দম্পতি বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও কৌশানী চট্টোপাধ্যায়ের একটি নিমন্ত্রণপত্রে লুকিয়ে আছে। মেয়ে কৈরভীর পৈতের আয়োজন করেছেন তাঁরা। যেখানে পত্রে স্থান-কাল ও সনির্বন্ধ আমন্ত্রণের সঙ্গে রয়েছে পাতাজোড়া ব্যাখ্যা, মেয়েদেরও উপনয়ন সম্ভব। তাঁরা দাবি করেছেন, বৈদিক যুগে মেয়েদের ‘দ্বিজা’ হওয়ার এই রেওয়াজ ছিল। সেটাই তাঁরা ফিরিয়ে আনতে চাইছেন।
কর্মসূত্রে কলকাতায় থিতু ওই দম্পতি আগামী ২০ মার্চ, তাঁদের সিউড়ির রামকৃষ্ণপল্লির বাসভবনে মেয়ের উপনয়নের আয়োজন করছেন তাঁরা। কার্ড ছাপিয়ে নিমন্ত্রণ শুরু হয়ে গিয়েছে। দম্পতি জানিয়েছেন, হঠাৎ ইচ্ছে থেকে নয়, তথ্য-প্রমাণের উপরে ভিত্তি করেই তাঁদের কন্যার ‘দ্বিজত্ব’ প্রাপ্তির অনুষ্ঠান করতে চাইছেন। মেয়েদের হৃত অধিকার ফিরে পাওয়া উচিত— এই ধারণাকে সামনে রেখেই তাঁদের এই সিদ্ধান্ত। দম্পতির কথায়, ‘‘সন্তান পুত্র হোক বা কন্যা, মা-বাবার কাছে তারা সমান। সমান তাদের অধিকার। তাই মেয়ের পৈতে দিচ্ছি।’’
বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি কলকাতার এনআরএস হাসপাতাল থেকে মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে শল্য চিকিৎসক পদে বদলি হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী কৌশানী চট্টোপাধ্যায় শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। কলকাতায় বি সি রায় চাইল্ড হাসপাতালে কর্মরত। থাকেন কলকাতার যাদবপুরে। মেয়ে কৈরভী (জ্যোৎস্না) কলকাতার একটি সিবিএসই অনুমোদিত স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী।
বসন্ত জানালেন, ২০১৪ সালে কৈরভীর অন্নপ্রাশনের সময় পুরোহিত যজ্ঞ করতে রাজি ছিলেন না। তাঁর মত ছিল, যজ্ঞ কেবল পুত্রের অন্নপ্রাশনের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। মেয়েদের বিয়ের সময় শুধু যজ্ঞ করা যায়। তখন প্রতিবাদ করেন তাঁর বাবা বাঁশরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। বসন্তের কথায়, ‘‘বাবার যুক্তি ছিল, ধর্মে এমন বিধিনিষেধ থাকার কথা নয়। শেষ পর্যন্ত পঞ্জিকা ঘেঁটে দেখা যায় বাধা নেই। তখনই মাথায় আসে পুত্রসন্তানের পৈতে হলে আমার মেয়েরও পৈতে দিতে হবে।’’ সেই মতো বই ঘেঁটে, ইস্কন ও বারাণসীর পাণিনি কন্যা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে কলকাতার আর্য সমাজ মন্দির, রবিশঙ্করের বৈদিক ধর্মসংস্থান—সব জায়গা থেকে খোঁজ নিয়ে দম্পতি নিশ্চিত হন যে, কন্যার উপনয়ন দেওয়া সম্ভব।
বসন্ত জানান, পশ্চিম বর্ধমানের বৈদিক সমাজই ঠিক করে দেয় উপনয়ন দেওয়ার দিনক্ষণ। কৌশানী বলছেন, ‘‘নিমন্ত্রণ করতে বার বার শুনছি, মেয়েদেরও পৈতে হয়? জবাব দিয়ে চলেছি। তবে আনন্দের বিষয় হল, জানার পরে অনেকেই বলেছেন, তাঁরাও মেয়ের পৈতে দেবেন।’’ তাঁর কথায়, ‘‘মেয়েদের এই সমান অধিকার, স্বীকৃতিটাই আমাদের লক্ষ্য।’’
যদিও বিপরীত মতও রয়েছে। নবদ্বীপের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্ত মনে করেন, সময় বদলেছে, তাই বৈদিক যুগের সব রীতি এ যুগে মানা অর্থহীন। অন্য দিকে, আধুনিক সময়ে উপনয়নের প্রাসঙ্গিকতা কতটা, সেই নিয়েও মুখ খুলেছেন কেউ কেউ।বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সবুজকলি সেন যেমন বলেন, ‘‘উপনয়ন ছেলেরই হোক মেয়ের, আধুনিক মুক্তমনা সমাজে এই প্রথার কোনও গুরুত্ব থাকা উচিত নয়। উপনয়ন নিলেই যে সে সমাজে উঁচু হয়ে যাবে— এই মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে। জাত, ধর্ম, লিঙ্গ, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকারই আধুনিক সমাজের মূল কথা।"
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy