এই বাড়ি থেকেই মৃতদেহগুলি উদ্ধার হয়। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।
কংক্রিটের রাস্তার ধারে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া বাড়িটা আজও দাঁড়িয়ে আছে। একই রকম ভাবে। ভিতরে ঢুকলে এখনও দেখা যায়, মেঝে, দেওয়াল, ছাদ পুড়ে কালো। এখনও বাড়ির চারপাশে জানলার কাচ ভাঙা অবস্থায় পড়ে।
২০২২ সালের ২২ মার্চ। সেই সকালে এই বাড়ি থেকেই বার করে আনা হয়েছিল সাত-সাতটি দগ্ধ মৃতদেহ। রামপুরহাট শহর ছাড়িয়ে ১৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে এগোলে এই বাড়ির আগেই পড়বে বগটুই মোড়, যেখানে তার আগের রাতে খুন হয়ে যান তৃণমূলের স্থানীয় উপপ্রধান ভাদু শেখ। তারই জেরে রাতে সোনা শেখের ওই বাড়িতে আগুন দেয় দুষ্কৃতীরা।
আপাতত সেই গ্রামে শান্তিকল্যাণ।
ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। বাসিন্দারা পেটের টানে সকালে কাজে বেরোচ্ছেন। তার পর?
একটি বাড়ির সামনে দাওয়ায় বসেছিলেন জনৈক প্রবীণ। বছর সত্তর বয়স। তাঁর কথায়, ‘‘২১ মার্চ রাতেই গল্পটা শেষ হয়ে যায়নি। ভাদু-খুন এবং তার পরে ১০ জনকে জ্যান্ত পুড়িয়ে আর কুপিয়ে মারার ঘটনায় যারা জেলে আছে, তারা কোনও কারণে বাইরে এলে গ্রামে আবার আগুন জ্বলবে। লিখে নিন এই কথা!’’
যে সন্ত্রাস সেই রাতে বগটুই দেখেছে, তার নেপথ্যে রয়েছে বালি-পাথরের কারবারের তোলাবাজি ও বখরা নিয়ে বিবাদ। দাবি, এর এক দিকে ছিলেন স্থানীয় বড়শাল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ভাদু শেখ, অন্য দিকে, সোনা শেখের মতো আরও কয়েক জন।
এখানেই গ্রামবাসীর আশঙ্কা। তাঁদের একাংশের দাবি, ভাদু খুন, তাঁর ছায়াসঙ্গী লালন শেখের সিবিআই হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ভাদু-অনুগামীরা মেনে নিতে পারেননি এখনও। ফলে, তাঁরা যে গ্রামে আবার কিছু ‘ঘটাবেন’ না, তার নিশ্চয়তা নেই। ভাদু-বিরোধীরা অনেকে অভিযুক্ত হিসাবে জেলবন্দি। ছাড়া পেলে তখন গ্রামে আবার আগুন জ্বলতে পারে, আশঙ্কা গ্রামের অনেকের। তাই মুখ খুললেও কেউ নাম বলতে চাইছেন না।
তেমনই আর এক বাসিন্দা জানালেন, ভাদু ও লালনের মৃত্যুর পরে এই মুহূর্তে বগটুইয়ে সেই অর্থে ‘মাথা’ কেউ নেই। তাই বগটুই গ্রামে বিভিন্ন দলের প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পেরেছেন। ফলে যে গ্রামে দীর্ঘদিন পদ্ম বা কাস্তে-হাতুড়ি-তারার খোঁজ মিলত না, সেখানে অনেক দলেরই পতাকা দেখা যাচ্ছে। স্বজনহারাদের বড় অংশই নাম লিখিয়েছেন গেরুয়া শিবিরে। প্রার্থীও হয়েছেন কয়েক জন।
তেমনই এক জন বগটুই পূর্বপাড়ার আসনের বিজেপি প্রার্থী মেরিনা বিবি। তাঁর স্পষ্ট দাবি, ‘‘তৃণমূলের সন্ত্রাসেই আমাদের আত্মীয়দের নৃশংস ভাবে খুন করা হয়েছে। সেই সন্ত্রাসের প্রতিবাদেই আমরা প্রার্থী হয়েছি।’’ স্বজনহারা বানিরুল শেখের পুত্রবধূ সীমা খাতুন রামপুরহাট-১ পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী হয়েছেন। বানিরুলের ছেলে কিরণ শেখ বলেন, ‘‘মা, বোন, জামাই-সহ অনেক আত্মীয়ের মৃত্যুর জন্য একমাত্র তৃণমূল দায়ী। তাই তৃণমূলের ব্লক সভাপতি জেল খাটছেন। আমরা গ্রামে তৃণমূলের সন্ত্রাসের প্রতিবাদে বিজেপির হয়ে ভোটে লড়াই করছি।’’
স্বজনহারা মিহিলাল শেখ এখন গ্রামের বিজেপি নেতাও বটে। তাঁর দাবি, ‘‘আমাদের প্রতি তৃণমূল সরকার যে অন্যায় করেছে, তার জবাব দেবে গ্রামবাসী।” পঞ্চায়েত ভোটের আগে বগটুই যে শাসক দলের বেশ বড় ‘মাথাব্যথা’, তার প্রমাণ মিলেছে। বীরভূমের দাপুটে তৃণমূল নেতা কাজল শেখকে ওই এলাকার দায়িত্ব দিয়েছেন খোদ দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কাজল এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। তবে বগটুইয়ের স্বজনহারাদের একাংশের ক্ষোভ যাঁর প্রতি যথেষ্ট, সেই রামপুরহাটের বর্ষীয়ান বিধায়ক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ঘটনার পরেই এলাকায় এসেছেন। পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং সমস্ত রকম সহযোগিতা করেছেন। এখন রাজনৈতিক ভাবে যদি কেউ বিরোধিতা করেন, সেটা তাঁদের ব্যাপার।’’
সাধারণ মানুষ কিন্তু রাজনীতির এত আলোচনায় নেই। বরং গত বছর সেই ২১ মার্চ রাত থেকে তাঁদের সঙ্গী আতঙ্ক। তাই গ্রামের বাসিন্দা মহম্মদ নাজিমউদ্দিন, ইয়ার সেলিমদের দাবি, ‘‘এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে আর কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে এসে ভোট হোক।’’
বলছেন, এবং ভয়ে ভয়ে এ-দিক ও-দিক তাকিয়েও নিচ্ছেন এক বার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy