সৌমেন্দ্রনাথ দাস।
বেশ কিছু দিন ধরেই শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। শেষ পর্যন্ত যখন জানতে পারলেন ফুসফুসে বাসা বেধেছে ক্যানসার, তত দিনে রোগ অনেকটাই ছড়িয়ে গিয়েছে। শারীরিক অবনতির মাঝেই হঠাৎ আরও এক ধাক্কা!
এপ্রিলের শেষ ভাগে কলকাতা হাই কোর্টের রায়ে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী চাকরিহারা। চাকরিটা আর নেই তাঁরও। তমলুকের বাসিন্দা সৌমেন্দ্রনাথ দাস। জীবনবিজ্ঞানের শিক্ষক। ২০১৯ সালের মার্চে পাথরপ্রতিমা ব্লকের গদামথুরা আদর্শ বিনয় বিদ্যাপীঠে নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি ছেড়ে হাই স্কুলে যোগ দিয়েছিলেন। স্ত্রী, বাবা-মা ও ভাই-ভাইয়ের স্ত্রীকে নিয়ে পরিবার। রয়েছে তিন ও ন’বছরের দুই কন্যাও। তারা অবশ্য এখনও বুঝে উঠতে পারেনি বাবার পরিস্থিতি।
কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না সৌমেন্দ্রও। প্রতিবেদককে বলেন, “আমার দুই মেয়ের নাম করে বলছি, কোনও দিন কাউকে টাকা দিইনি।”
চিকিৎসার জন্য মাসে খরচ প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। প্রথমে শ্বাসকষ্টের জন্য ডাক্তার দেখাচ্ছিলেন। পরিস্থিতির অবনতি হলে মুম্বইয়ে টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে দেখাতে যান। তখনই প্রথম জানতে পারেন, ক্যানসার বাসা বেধেছে শরীরে। চিকিৎসকেরা জানান, কেমোথেরাপির মাধ্যমে আয়ু বড়জোর এক বছর। চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেন, হায়দরাবাদ থেকে মলিকিউলার পরীক্ষা করতে। সেই পরীক্ষায় ফল পজ়িটিভ হলে চিকিৎসার মাধ্যমে তিন-চার বছর বাঁচানো যেতে পারে। পরীক্ষার ফল পজ়িটিভ এলে যে ওষুধ দেওয়া হয়, তার মধ্যে রয়েছে বিশেষ সংস্থার তৈরি ট্যাবলেট। ১৫টি ট্যাবলেটের দাম ১ লক্ষ ২০ হাজার। ওই সংস্থার পক্ষ থেকে সৌমেন্দ্রকে আরও ১৫টি ট্যাবলেট বিনামূল্যে দেওয়া হয়। ফলে এক মাস চলে যায়। তবে অন্যান্য পরীক্ষা, চিকিৎসার খরচ ও মুম্বইয়ে যাতায়াত মিলিয়ে মাসে খরচ প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। শনিবার আবার মুম্বই গিয়েছেন সৌমেন্দ্র।
বিপুল খরচের মোকাবিলায় কয়েক জন বন্ধু একটি অ্যাপ তৈরির পরামর্শ দিয়েছিলেন। ওই অ্যাপের মাধ্যমেই সৌমেন্দ্রর চিকিৎসার খরচ জোগাড়ের পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু ওই স্কুল শিক্ষক বন্ধুরাও আদালতের রায়ে চাকরিহারা। অ্যাপটি তৈরি হলেও তাই তার ভবিষ্যৎ এখন বিশবাঁও জলে।
ক্যানসার চিহ্নিত হতেই স্কুলে বদলির আবেদন জানিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের শরণাপন্ন হন সৌমেন্দ্র। এক আইনজীবী প্রায় নিখরচায় মামলা লড়েন। বদলির নির্দেশও আসে। মেডিক্যাল পরীক্ষার রিপোর্ট পাঠানোর পরে শিক্ষা দফতরের আনুষ্ঠানিক সম্মতির প্রক্রিয়াটুকু বাকি ছিল। এর মধ্যেই হাই কোর্টের সেই রায়।
সৌমেন্দ্রর স্কুলের প্রধান শিক্ষক সৌরভ কুমার ঘোষ বলেন, “সৌমেন্দ্র শিক্ষক হিসেবে খুবই ভাল। ওর অসুস্থতার কথা শুনে আমাদের এবং পড়ুয়াদের মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল। ওর বদলির ক্ষেত্রেও আমরা যতটা সম্ভব সহযোগিতা করেছি।”
সৌমেন্দ্র সোমা দাসের কথা জানেন। ক্যানসার আক্রান্ত এই চাকরিপ্রত্যাশীর শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে তাঁকে চাকরি দিতে সুপারিশ করেছিল আদালত। সেই বিষয়টি জানাতে, সৌমেন্দ্রর আইনজীবী বলেন, হাই কোর্টের মামলায় পার্টি থাকলে হয়তো সুরাহা হত। কিন্তু এখন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া কোনও রাস্তা নেই। সৌমেন্দ্র বলেন, “কী করে ভাবব, আমার চাকরিটা চলে যাবে! আগে বুঝলে বদলির আবেদনের সময়েই হাই কোর্টের মামলাতেও পার্টি হয়ে যেতাম।”
সৌমেন্দ্রর কথায় সম্মতি জানান তাঁর স্ত্রী প্রত্যুষা পাণিগ্রাহি দাসও। তিনি বলেন, “সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছি। আমি চাই, প্রমাণ হোক উনি নিষ্কলঙ্ক। টাকা দিয়ে চাকরি পাননি। মামলা চালাতে প্রয়োজনে গয়না বন্ধক রাখব।”
কিন্তু আদালতেও যদি স্বস্তি না মেলে? চুপ করে যান সৌমেন্দ্র। পাশে স্ত্রীর চোখে তখন নোনা জলের বৃষ্টি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy