বীরভূমের আনসুরা বিবি। ছবি: বাসুদেব ঘোষ।
‘শাড়ির জমিন আসমানি
আর পাড় দু’খানি ধানি,
মাঝে কাশফুলের সাদা
সাথে হলুদ-কমলা মাটি।’
তাঁর কোল ছলকে, জল-কাদা মাখা উঠোন পেরিয়ে, এঁদো গলিকে হারিয়ে শাড়ি যেন ছুটে চলে নদীর মতো। পদ্ম, মাছ, ঘরের চাল বেয়ে ওঠা মাধবীলতা ফুটে থাকে শাড়িতে। ভাঙা ছাদ, ত্রিপল ঘেরা বারান্দার সামনে টিনের দোলনায় পাখিদের খাবার জায়গা, উঠোনে বেড়ে ওঠা জবা, নয়নতারা কেমন যেন মায়া মাখিয়ে দেয় চোখে। সে বাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়ে ছেলেমেয়ে কোলে উড়ে যায় এক ঝাঁক লাল-হলুদ ঘোমটা দেওয়া, কালো বোরখা পরা পাখি। এই পাখিরাই আনসুরার ডানা। আর আনসুরা এদের বাসা। যেখানে দশ হাতে ঘরের কাজ সামলানোর তাড়া থাকে না, ‘ভাতটা গলে কেন বৌ, মন কোন দিকে’ বলার কেউ থাকে না। শুধু নকশি কাঁথায় ফুটে ওঠে জীবনের গল্প।
চার ছেলেমেয়ে নিয়ে দুর্গার মতোই সুতোর টানে সংসারের পুতুল-খেলা সামলান আনসুরা বিবি। সুতো ছড়ান, গোটান, পাশাপাশি, আগে-পরে, এ-ফোঁড় ও-ফোঁড়ে বোনা হয়ে যায় রূপকথা। বয়স কত হবে? বড়জোর ৩৮। নকশা আঁকা, স্বচ্ছ কাগজে সুচ ফুটিয়ে সেই নকশার ধাঁচা তৈরি করেন তিনি। কখনও চোখে ঘুম লাগলে আঙুলে সুচ ফুটে দু’ফোটা রক্ত বেরিয়ে পড়ে। দাগ মুছে আবার চলতে থাকেন তিনি। পার্বতীর পিছু পিছু চলেন ভোলানাথ শেখ জব্বার আলি। আগে যে হাতে কাঠ কুঁদে আসবাব বানাতেন, সেই হাতে শাড়ি ভাঁজ করেন। দোকান গুছিয়ে দেন। দূর-দূরান্তের মেলায় জুটিতেই যান তাঁরা।
কদ্দিন করছেন এ কাজ? তা ১০ বছর হবে, উত্তর আসে। নামতার মতো ২, ৪, ৬, ৮, ১০ করে বাড়তে বাড়তে ২০-২৫ জন মেয়েকে শাড়ি, কাপড়, ব্যাগ, কুর্তি, ওড়নায় সুচের রকমারি ফোঁড় শেখান আনসুরা। গ্রামের অন্য মেয়েদের প্রয়োজনে, কাজ দিয়ে হাতখরচের জোগান দিয়ে স্বনির্ভর হতে, লড়তে শেখান।
বোলপুর থেকে শান্তিনিকেতন ছুঁয়ে বেঁকে যায় বিনুড়িয়ার পথ। নীল আকাশ, দু’ধারের ধান জমি, কাশফুল, মেঘ-রোদের লুকোচুরি আনসুরার কোলের ওই শাড়িই যেন। মসৃণ জমিন যেতে যেতে যেখানে হোঁচট খায় কাদায়, সেই রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে একটা গাড়ি। আনসুরাদের বস্ত্র বিপণি। বৈশাখে বাড়ির চাল উড়ে যাওয়ার পর থেকে হাতের কাজ সব থাকে ওখানেই। কলকাতায়, রাজ্যের বাইরে মেলাতেও যান ওই গাড়ি নিয়েই। ‘‘জানো তো দিদি, ঝড়টা যখন উঠল, ছোট মেয়েটা কোলেই ছিল। ছাদটা উড়ে গিয়ে মাথার উপরে খোলা আকাশ তখন।’’ এখনও চাল ছাওয়া হয়নি। ত্রিপলই সম্বল মাথার উপর। তাই নিজের ঘরে মেয়েদের বসিয়ে কাজ করানো এখনও সম্ভব হয়নি।
পুজোর আগের বৃষ্টিতে পড়শির আরশিনগরেই নকশি কাঁথা বিছোন আনসুরা। থান কিনে তাতে নকশা এঁকে দেন। সেই আঁকায় সুচ-সুতো দিয়ে নকশা ফোটান সপ্তমী, সাবিনারা। বছরের অন্য সময় কাজ কম থাকে। তখন শাড়ি নিয়ে গিয়ে বাড়িতেই কাজ করেন তাঁরা। কিন্তু পুজোর কয়েক মাস সকাল সকাল ঘর-সংসার সামলে আনসুরার কাছে হাজির হয়ে যান। কোলে ছেলে নিয়ে গল্প-হাসির মাঝেই হাত চলে। প্লাস্টিকে বাঁধা মুড়িতে যে দিন চপ-বেগুনি পড়ে, সে দিনই উৎসব। বেলা গড়ায়। সন্ধ্যাপ্রদীপ, তুলসীতলা, টিভি সিরিয়াল, হাসিকান্না, হীরাপান্নায় তালে তালে দোলে ভাল-মন্দ। পাছে পাছে নাচে জন্ম-মৃত্যু...।
পুজোটাই তাঁদের রোজগারের সময়, সুখের সময়। বেশির ভাগ বরাত আসে এই সময়ে। আবার বেশি করে জিনিস তৈরি করে দোকানে বা পুজোর মুখে নানা মেলায় পৌঁছে যেতে পারলেও বিক্রি ভালই হয়। এখন মুঠোফোনে অনলাইনে কিছু গ্রুপ, পেজেও নিজেদের তৈরি শাড়ির ছবি পাঠান আনসুরা। তাঁর কথায়, ‘‘অনেকেই ফোন করেন। দাম জিজ্ঞাসা করেন। তবে বিক্রি খুব বেশি হয় না। কিন্তু অনলাইনে অন্যদের তৈরি জিনিস দেখার সুবিধাও আছে।’’ আনসুরা জানান, কারও শাড়ি, চাদরে নকশা পছন্দ হলে মাথায় গেঁথে নেন। তার পরে নিজের মতো করে নকশা কাটেন।
অনলাইনে মাঝে মাঝে নাতির খেলনা দেখেন বাঁকাজোলের কাকলি। বোলপুর থেকে কিলোমিটার দশেক দূরের গ্রামের আদিবাসী পাড়ায় ঢুকে খানিকটা যেতেই মারাংবুরুর থান। নোংরা রাস্তার পাশেই রুখুসুখ চেহারার দুই বৃদ্ধ বসে আছেন। কাকলি টুডুর বাড়ি কোনটা? ‘উ...ই যে’, আঙুল উঁচিয়ে দেখান এক বৃদ্ধ। তকতকে পরিষ্কার উঠোন, গাছে ঘেরা বাড়ি। তবে সুতো, নকশার কথা বললেই আনমনা হয়ে যান তিনি। বারো হাতের শাড়ি আর সাজানো হয় না তাঁর।
নিঃসন্তান কাকলির ঘরে ছেলে, বৌমা, নাতি-নাতনি সব আছে। সবই দেওর-জায়ের। তাঁরা করোনাকালে চলে গেলে এখন সংসার কাকলির। বৌমা পূজাকে সেলাই শেখানোর ফাঁকে কাকলি বলেন, ‘‘আগে অনেক মেয়ে আমার সঙ্গে কাজ করত। কিন্তু করোনা সব শেষ করে দিল। আমাদের মতো ঘরে পুঁজি আর কত থাকে! বাড়ির কারও কাজ ছিল না। পুঁজি ভেঙে ভাত জোগাতে গিয়ে, সব শেষ।’’ এখন যেমন বরাত আসে, তেমন বোনেন তিনি। শাড়িতে লগ্নি বেশি, তাই বারো হাতের জমিতে বারো মাসের গল্প শোনানো হয় না। কুর্তি আর পাঞ্জাবিতেই কাঁথার কাজ করেন। কঙ্কালীতলা মন্দিরের কাছে একটা স্টল আছে তাঁর। পর্যটকেরাই মূলত ক্রেতা। অনলাইনে ব্যবসা করেন না?
কাকলি জানান, অ্যান্ড্রয়েড ফোন পেয়ে কিছুটা সুবিধা হয়েছে তাঁর। নানা রকম নকশা দেখা যায়, কেমন জিনিস ক্রেতারা বেশি চান, সেই সব বোঝা যায়। গ্রামের অন্য মেয়েরা কাজ শেখেন না? কাকলি বলেন, ‘‘আদিবাসীদের মধ্যে সেলাইয়ের থেকে হাতের কাজের প্রবণতা বেশি। ঝুড়ি, মাদুর বোনায় অনেক মেয়ে পাওয়া যায়। কিন্তু সেলাইয়ের কাজ করতে আগ্রহ নেই ওদের। তাই আশপাশের অন্য গ্রাম থেকেই মেয়েদের কাজে নিতে হয়।’’
তবে ভাল কাপড়ে পুরো কাঁথার কাজ করতে যত খরচ হয়, সেই অনুযায়ী দাম মেলে না, আক্ষেপ তাঁর। আলমারি থেকে একের পর এক কাজ করা পাঞ্জাবি বার করেন তিনি। কবে কোনটা এঁকেছিলেন, টেনে আনেন। আবার শাড়িতে কাজ করলে জমিন কেমন হবে, পাড় কেমন হবে, আঁচলে কোন নকশা হবে.... চশমার কাচের ভিতরে চকচক করে ওঠে চোখ। হাত বাঁধা হলেও মন বাঁধা যায় না। দু’চোখে সাদা জমির খোলে নীল সুতোয় নাতির মানুষ হওয়া, লাল সুতোয় নাতনির লেখাপড়া-বিয়ে, হলুদ-গোলাপি সুতোয় ছেলে-বৌমার উথলে ওঠা সংসার, সবুজ সুতোয় বুড়োবুড়ির ভাল থাকা বুনে চলেন তিনি।
হাওয়ায় ওঠে পুজোর বোল। খড়ের কাঠামোয় মাটি পড়ে, রং পড়ে। চিরকালীন বাঙালি এক মায়ের মূর্তি গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে। সে সব দেখতে দেখতে কাকলি ভাবেন, আবার চাকা ঘুরবে! তাঁর সুতোর রঙেই পান্না হবে সবুজ, চুনি উঠবে রাঙা হয়ে। আকাশে চোখ মেললে আসমানি শাড়ি, দু’পাড়ের ধানি জমি, মাটির গন্ধে ফোঁড় তুলবে আর এক নকশি কাঁথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy