ধান খেত থেকে ফসল তুলতে ব্যস্ত আলো। ডান দিকে, বাবা-মায়ের সঙ্গে রিভু ভক্তা। নিজস্ব চিত্র।
এক জনের বাবা মুদি দোকানের সামান্য বেতনের কর্মী। অন্য জনের বাবা বাড়ি বাড়ি ঘুরে মাছ বিক্রি করেন। টানাটানির সংসার। কিন্তু, মেধা এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করার নেশা তাঁদের দু’জনেরই। তারই জোরে সর্বভারতীয় ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষা নিটে নজরকাড়া ফল করেছেন বীরভূমের আলো মণ্ডল এবং হাওড়ার রিভু ভক্তা।
নিটে ৭২০ নম্বরের মধ্যে ৬২৮ পেয়ে সর্বভারতীয় ভাবে ৮৯৭২ স্থানে রয়েছেন খয়রাশোল ব্লকের ছোড়া গ্রামের তরুণী আলো। শতকরা স্কোর ৯৯.৪১। শ্যামপুরের রাজীবপুর গ্রামের তরুণ রিভু ৭২০-র মধ্যে পেয়েছেন ৫৯২ নম্বর। এই দু’জনই তাঁদের মেধা ও অধ্যবসায়ে শুধু নিজেদের পরিবারকে নয়, গর্বিত করেছেন গোটা গ্রামকেই। ঘরের ছেলেমেয়ের গলায় ঝুলবে স্টেথোস্কোপ, ভেবেই আনন্দে মাতোয়ারা দুই জেলার দুই প্রান্তিক পরিবার।
২০১৮ সালে মাধ্যমিকে ৬৪২ পেয়ে আলো গ্রামের স্কুলের সেরা হয়েছিলেন। এর পরে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার জন্য দুবরাজপুর শহরে সারদেশ্বরী বিদ্যামন্দির ফর গার্লসে ভর্তি হন তিনি। সে জন্য গ্রামের বাড়ি থেকে দুবরাজপুরে এসে এক কামরার একটি ঘর ভাড়া নেয় পরিবার। আলোর বাবা নগেন্দ্রচন্দ্র মণ্ডল বলছিলেন, ‘‘মাসে হাজার ছয়েক টাকা আয় থেকে ঘর ভাড়া মেটানো খুব কষ্টকর ছিল। তবে শিক্ষকেরা বিনা পারিশ্রমিকে দেখিয়ে দেওয়ায় কিছুটা ভার লাঘব হয়। মেয়ে আমাদের নিরাশ করেনি।’’ গত বছর উচ্চ মাধ্যমিকে ৪৮৬ পেয়ে ফের স্কুলের সেরা হয় আলো। তার পরই সর্বভারতীয় ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু।
বাড়িতে বসে প্রস্তুতি ফাঁকেই মাঠে গিয়ে ধান রোঁয়া, বাবাকে খাবার দিতে যাওয়া, ধান কাটা—সব কাজই করতে হয়েছে আলোকে। তাঁর কথায়, ‘‘শিক্ষক শিক্ষিকারাই আমাকে এই স্বপ্ন তাড়া করতে উৎসাহিত করেন। কলেজে ভর্তি হলেও লক্ষ্য ছিল নিট। কন্যাশ্রীর ২৫ হাজার টাকা, এবং বেশ কয়েকটি স্কলারশিপের টাকা দিয়ে কোচিং নিয়েছেন।
রিভু অবশ্য কোচিংয়ের সুযোগও পাননি। তা হলে সাফল্যের পিছনে কী? তাঁর কথায়, ‘‘বন্ধুদের মুখে শুনেছি, কোচিং নিতে অনেক টাকা লাগে। তাই নিজেই ইউটিউব দেখে পড়াশোনা করতাম। উচ্চ মাধ্যমিকের বইগুলোও মন দিয়ে পড়তাম। তাতেই ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েছি।’’ ছোট থেকেই তাঁর ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। শ্যামপুর হাই স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে ৪৮৪ নম্বর পেয়ে পেয়ে স্বপ্নপূরণের দৌড় শুরু হয়।
বড় ছেলে রিভু, মেয়ে সুকন্যা এবং স্ত্রী মমতাকে নিয়ে লক্ষ্মীকান্ত ভক্তার সংসার। সুকন্যা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। সংসারে অনটন থাকলেও ছেলেমেয়ের পড়াশোনোর প্রতি দম্পতি নজর দেন সব সময়। লক্ষ্মীকান্তবাবু বললেন, ‘‘ভোর তিনটেয় উঠে আড়তে মাছ বিক্রি করতে যাই। দুপুর পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি বিক্রি করি। কোনও রকমে সংসার চলে। ছেলে ডাক্তার হবে জেনে আনন্দ হচ্ছে।’’
রিভুর গ্রামে কোনও ডাক্তার নেই। ডাক্তার দেখাতে দূরে যেতে হয়। রিভুকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছেন গ্রামের মানুষও। দুই পরিবারে চিন্তা একটাই—উচ্চ শিক্ষার খরচ। ‘‘এত দিন বহু মানুষের সহযোগিতা পেয়েছি। ভবিষ্যতেও পাব জানি।’’—প্রত্যয়ী শোনায় দুই হবু ডাক্তারের গলা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy