ছেলেদের পোশাক পরতে ইচ্ছা হত না তার। বরাবরই চোখ টানত শাড়ি আর সালোয়ার কামিজ। তবু তার মা জোর করে ছেলেদের পোশাক পরিয়ে ছেলেদের স্কুলে যেতে বাধ্য করতেন বলে বাড়ি ছেড়েছিল মহারাষ্ট্রের গুলাব। এ রাজ্যের সীমান্তে ঘোরাঘুরি করতে দেখে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে। নিয়ে যাওয়া হয় সরকারি হোমে। জানা যায়, সে তৃতীয় লিঙ্গের একজন। আর তার পরেই তাকে কোন হোমে রাখা হবে, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে রীতিমতো তোলপাড় শুরু হয় রাজ্য সমাজকল্যাণ দফতরে।
ফর্সা, ছিপছিপে, শার্ট-প্যান্ট পরা ছেলেটিকে ইন্দো-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি গোপালনগরে ইতস্তত ঘুরতে দেখেই সন্দেহ হয়েছিল পুলিশের। তাকে বাংলাদেশি ভেবে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে গোপালনগর থানার পুলিশ। তখনই জানা যায় তার নাম গুলাব। তবে চেহারা দেখে পুলিশের ধারণা হয়েছিল, তার বয়স বড়জোর বছর চোদ্দ। তাই তাকে হাজির করা হয় উত্তর ২৪ পরগনা জেলার শিশু কল্যাণ সমিতির কাছে। সেখান থেকে তার ঠাঁই হয় সরকারি হোম কিশলয়ে। আর তখনই জটিলতার সূত্রপাত। কারণ, হোমে গিয়েই গুলাব অন্য ছেলেদের সঙ্গে থাকতে অস্বীকার করে। বলে, ‘‘আমি মেয়ে। ছেলেদের সঙ্গে কেন থাকব!’’ হোম কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি খবর পাঠান শিশু কল্যাণ সমিতিকে। সমিতির কর্মীরা তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে বুঝতে পারেন, গুলাব ছেলে নয়, মেয়েও নয়। সে তৃতীয় লিঙ্গের একজন এবং সে বাংলাদেশি নয়, মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা।
ঠিক যে ভাবে হাসপাতালে কোনও তৃতীয় লিঙ্গের রোগী এলে তাঁকে পুরুষ না মহিলা-কোন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হবে, সেই ধন্দে আটকে থাকে চিকিৎসা, এ ক্ষেত্রেও গুলাবের ভবিষ্যৎ নিয়ে শুরু হয়েছিল তেমনই টানাপড়েন। কোথায় ঠাঁই দেওয়া
হবে তাকে?
গুলাব তার ব্যাগ খুলে শাড়ি, ব্লাউজ, সালোয়ার-কামিজ দেখায়। জানায়, বাড়িতে তার মা-ও কিছুতেই মানতে চাইতেন না যে সে আদতে একজন মেয়ে। তাকে ছেলেদের মতো থাকতে বাধ্য করা হত বলে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছে সে। ইচ্ছা, বাংলাদেশ যাবে। রাত-বিরেতে এ রকম এক কমবয়সী তৃতীয় লিঙ্গের কাউকে কোথায় পাঠাবেন ভেবে মাথায় হাত পড়ে হোম কর্তৃপক্ষ এবং সমিতির। কারণ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী তৃতীয় লিঙ্গের জন্য থানা, হাসপাতালে আলাদা ব্যবস্থা এবং আলাদা হোম করতে হবে। অথচ এ রাজ্যে এদের জন্য কোথাওই কোনও আলাদা
ব্যবস্থা নেই!
পরের চার-পাঁচ দিন ওই হোমেই আলাদা করে রাখা হয় গুলাবকে। কিন্তু তার পরে ডাক্তারি পরীক্ষায় তার বয়স ১৮ বছরের বেশি বলে প্রমাণিত হওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন কর্তৃপক্ষ। বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয় গুলাবকে। সমাজকল্যাণ দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘তৃতীয় লিঙ্গের কাউকে উদ্ধার করলে কিংবা আটক করলে এ ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় বলে পুলিশও সাধারণত এঁদের ধরে না। কারণ এঁদের ধরলে আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে বলে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু হোম বা জেল-কোথাওই তো আলাদা
ব্যবস্থা নেই।’’
প্রশ্ন উঠেছে, এ বার না হয় কোনওক্রমে দায় এড়াল প্রশাসন। ভবিষ্যতে আবার এমন কেউ এলে তাকে নিয়ে কী হবে? রাজ্যের নারী, শিশু ও সমাজ কল্যাণ দফতরের সচিব রোশনি সেন বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত তৃতীয় লিঙ্গের কাউকে কখনও হোমে রাখার দরকার পড়েনি। কিন্তু এ রকম সমস্যা যে হেতু এ বার দেখা দিল, তাই এ বার আমাদেরও কিছু একটা আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে। তবে আলাদা কোনও হোম তো এই মুহূর্তে তৈরি করা সম্ভব নয়। বর্তমানে যে হোম রয়েছে, সেখানেই আলাদা করে এদের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে।’’
এ রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে গঠিত হয়েছে ট্রান্সজেন্ডার বোর্ড। সরকারি হাসপাতালেও লিঙ্গ পরিবর্তনের অস্ত্রোপচার শুরু হয়েছে। দিন কয়েক আগে বাংলাদেশ থেকে এসে পরিবারের উপস্থিতিতে ওই সরকারি হাসপাতালেই এক প্রৌঢ়ের লিঙ্গ পরিবর্তন করানোর সাক্ষী থেকেছে এই শহর। তার পরেও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে কেন এমন উদাসীনতা? রাজ্য ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডের সদস্য রঞ্জিতা সিনহা বলেন, ‘‘তৃতীয় লিঙ্গের জন্য আইন হয়ে গিয়েছে দু’ বছর হয়ে গেল। আর এ রাজ্যে আবার তাঁদের উন্নয়নের জন্য বোর্ড হয়েছে। কিন্তু এঁদের জন্য আলাদা কোনও হোম, শৌচালয় কিংবা কোনও ব্যবস্থাই করা হয়নি। এটা দুর্ভাগ্যজনক বিষয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy