বাবা নয়, কাকিমার বাবা-মায়ের কাছে থাকতে চায় সে। বৃহস্পতিবার রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের সামনে এ কথাই জানিয়েছে ট্যাংরা-কাণ্ডে বেঁচে ফেরা বছর চোদ্দোর কিশোর। সে বলেছে, ‘‘বাবাও আমায় মারতে চেয়েছিল। কাকিমার বাবা-মা আমায় খুব ভালবাসেন। আমি ওই দাদু-দিদার কাছেই থাকতে চাই।’’ তবে কিশোরের এই ইচ্ছা পূরণ হবে কি না, তার নিশ্চয়তা মেলেনি রাত পর্যন্ত।
পুলিশ সূত্রের খবর, ওই কিশোরের নিজের দাদু-দিদিমা বেঁচে নেই। এই অবস্থায় তার কাকিমা, অর্থাৎ ইতিমধ্যেই খুন হওয়া রোমি দে-র মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু পরিবারের কয়েক জনের অমতে তাঁরা এখনও এ বিষয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত জানাননি। বিষয়টি নিয়ে এ বার শিশু সুরক্ষা কমিশনের তরফে রোমির মা-বাবার সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই কিশোরের ১৮ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত সরকারি ভাতা পাওয়ার কথা জানিয়ে তাঁদের রাজি করানোর চেষ্টা চলছে বলে সূত্রের দাবি। তবে এর পরেও তাঁরা রাজি না হলে অন্য পথ ভাবা হবে বলে জানালেন এ দিন ওই কিশোরের সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করতে যাওয়া কমিশনের উপদেষ্টা অনন্যা চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘বাচ্চাটির জন্য একটা ভাল ঘরের খোঁজ করা এখন প্রধান কাজ। ছেলেটি ওর কাকিমার বাবা-মায়ের কাছে থাকতে চায়। তাঁদের রাজি করাতে আমরা নিজেরা চেষ্টা করব। না হলে পরবর্তী পদক্ষেপ ভাবা হবে।’’
কিন্তু শিশু অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তদের দাবি, ঘটনার পরে ১০ দিনের বেশি কেটে গেলেও ওই কিশোরের কোনও নিশ্চিত বন্দোবস্ত না হওয়ায় প্রশ্ন উঠছে। তাকে এই মুহূর্তে রাখা হয়েছে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে সে কার্যত পুলিশের নজরবন্দি হয়ে রয়েছে। পাশের ঘরেই বাবা থাকলেও তাকে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। কোনও আত্মীয়স্বজনও দেখা করতে যাচ্ছেন না ওই কিশোরের সঙ্গে। এই পরিস্থিতিতে ১৪ বছরের এক কিশোরের মনে কী পরিমাণ চাপ সৃষ্টি হতে পারে, তা নিয়ে সরব শিশু অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই। তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘বাবা কবে সুস্থ হবে, তার পরে কেন ছেলেটির কোনও সুবন্দোবস্ত হবে? কেন এখনই ওর সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না?’’ পুলিশের তরফে যদিও দাবি, ওই কিশোরের চিকিৎসা চলছে। তার পরেই তাকে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির কাছে হাজির করানো হবে।
শিশু অধিকার রক্ষা নিয়ে কাজ করা আইনজীবী দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘কতটা মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে ওই কিশোর যাচ্ছে, তা আন্দাজ করাই শক্ত। ‘চাইল্ড ইন নিড অফ কেয়ার অ্যান্ড প্রোটেকশন’ হিসাবে উল্লেখ করে শিশু সুরক্ষা কমিশনই তো স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে পদক্ষেপ করতে পারে। তারা চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটিকে নির্দেশ দিতে পারে, বাচ্চাটিকে এখনই কমিটির সামনে হাজির করে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করার জন্য।’’ দেবাশিস জানান, এ ক্ষেত্রে যে হেতু কোনও আত্মীয় এখনও কিশোরটির দায়িত্ব নিতে চাননি, তাই তাকে সরকারি হোমে পাঠানো যেতে পারে অথবা কোনও পরিজন বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাউকে ‘ফিট পার্সন’ হিসাবে কিশোরের দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। ইতিমধ্যে অনেকে কিশোরটির দায়িত্ব নিতে চেয়ে শিশু সুরক্ষা কমিশনে এবং নানা মাধ্যমে আবেদন জানিয়েছেন বলে খবর। যদিও আইনজীবীরা জানাচ্ছেন, কিশোরটিকে দত্তক নেওয়ার পথ ততটা কার্যকর নয়। আইনজীবীদের দাবি, যে হেতু কিশোরটির বাবা জীবিত, তাই পরিবারের সঙ্গে থাকার অধিকারের ভিত্তিতে তাকে দত্তক দেওয়া এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে নিজের সন্তানের দায়িত্ব নিতে চান না বলে হলফনামা দিতে হবে কিশোরের বাবাকে। কিশোরটির বয়স যে হেতু ১৪ বছর ও তার একটা নিজস্ব মতামত তৈরি হয়েছে, তাই সে কোথায় থাকতে চায়, সেটাও দেখতে হবে।
কমিশনের উপদেষ্টা অনন্যা বললেন, ‘‘পুলিশ যে হেতু অনেকটাই কাজ করে ফেলেছে, তাই এ ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে কিছু করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। এখন বাচ্চাটির আত্মীয়দের রাজি করানোই মূল লক্ষ্য। বাচ্চাটি যত দ্রুত কোনও ঘরে যাবে, ততই তার মানসিক বিকাশের পক্ষে মঙ্গল।’’ কিন্তু আর কত দিন? স্পষ্ট উত্তর মিলছে না।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)