Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

তাপস পাল গ্রেফতার, রোজ ভ্যালি মামলায় আজ ভুবনেশ্বর আদালতে

সংস্থার কর্ণধার ধরা পড়েছেন পৌনে দু’বছর হয়ে গেল। মাস ছয়েক আগে সিবিআই তাঁকে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল ভুবনেশ্বরে। গোয়েন্দাদের দাবি, রোজ ভ্যালি কর্তা গৌতম কুণ্ডু সেখানেই জেরার মুখে ঝাঁপি খুলে দেন। আর তাতেই বেরিয়ে আসে ওজনদার বেশ কিছু নাম। যাঁদের অন্যতম— তৃণমূলের সাংসদ তথা অভিনেতা তাপস পাল।

সিবিআই হেফাজতে তাপস পাল। শুক্রবার। ছবি: সুমন বল্লভ।

সিবিআই হেফাজতে তাপস পাল। শুক্রবার। ছবি: সুমন বল্লভ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৪:১৪
Share: Save:

সংস্থার কর্ণধার ধরা পড়েছেন পৌনে দু’বছর হয়ে গেল। মাস ছয়েক আগে সিবিআই তাঁকে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল ভুবনেশ্বরে। গোয়েন্দাদের দাবি, রোজ ভ্যালি কর্তা গৌতম কুণ্ডু সেখানেই জেরার মুখে ঝাঁপি খুলে দেন। আর তাতেই বেরিয়ে আসে ওজনদার বেশ কিছু নাম। যাঁদের অন্যতম— তৃণমূলের সাংসদ তথা অভিনেতা তাপস পাল।

রোজ ভ্যালি অর্থলগ্নি সংস্থার মামলায় এ বার সেই তাপস পালকে গ্রেফতার করল সিবিআই। শুক্রবার সকালে তাঁকে সল্টলেকে সিবিআই দফতরে ডেকে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পরে সিবিআই নিজের হেফাজতে নিয়েছে। কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো সূত্রের খবর: রোজ ভ্যালির বিরুদ্ধে সিবিআই যে হেতু ভুবনেশ্বরে মামলা রুজু করেছে, তাই এ দিন রাতে তাপসকে বিমানে চাপিয়ে ভুবনেশ্বরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আজ, শনিবার তাঁকে ওখানকার কোর্টে তোলা হবে।

সূত্রের খবর: মাস ছয়েক আগে কলকাতার বাছাই করা দুঁদে সিবিআই অফিসারেরা ভুবনেশ্বরে গিয়ে গৌতম কুণ্ডুকে খুঁটিয়ে জেরা করেন। গৌতম তখনই তদন্তকারীদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন একটি তালিকা, যাতে একাধিক রাজনৈতিক নেতা-সহ বেশ কিছু প্রভাবশালীর নাম আছে। ‘‘গত ছ’মাস ধরে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করা হয়েছে। এখন চালু হয়েছে অ্যাকশন।’’— মন্তব্য এক কেন্দ্রীয় গোয়েন্দার।

এবং তারই প্রথম ধাপে তাপসকে ধরা হল বলে ওঁদের দাবি। ‘দাদার কীর্তি’ ও ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’র নায়ককে এ দিন সকালে সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে সিবিআই দফতরে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। চার ঘণ্টা জেরাপর্বের শেষে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তাপসের বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের মূল অভিযোগ— সাধারণ মানুষের কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের যে ষড়যন্ত্র রোজ ভ্যালি ছকেছিল, তিনিও তাতে সামিল ছিলেন। লগ্নিসংস্থাটির হয়ে খুল্লমখুল্লা প্রচারও চালিয়েছেন ওই সাংসদ-অভিনেতা। প্রসঙ্গত, সারদা কেলেঙ্কারিতে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্র গ্রেফতার হয়েছিলেন প্রায় একই রকম অভিযোগে।

সিবিআই প্রশ্ন তুলেছে, তাপস পাল এক জন সাংসদ হয়েও রোজ ভ্যালি থেকে নিয়মিত বেতন নিতেন কোন যুক্তিতে?

বস্তুত সাংসদ হওয়ার পরে, ২০১০ সালেও তাপসের বিরুদ্ধে অভিযোগটা উঠেছিল। এমনকী, মামলাও হয়েছিল। পরে তা ধামাচাপা পড়ে যায়। অভিযোগ, তাপস তখন রোজ ভ্যালির চেয়ার ছাড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও বেশ কিছু দিন পদ আঁকড়ে রাখেন। শেষে নদিয়ার জনসভায় তাঁর বিতর্কিত মন্তব্য ঘিরে শোরগোল শুরু হলে ডিরেক্টর পদে ইস্তফা দেন। সিবিআইয়ের দাবি: ডিরেক্টর হিসেবে রোজ ভ্যালি থেকে তাপস নিয়মিত

মাইনে তো নিতেনই, উপরন্তু সংস্থাটি বাজার থেকে অবৈধ উপায়ে টাকা তুলছে জেনেও আগাগোড়া নিশ্চেষ্ট থেকেছেন। শুধু তা-ই নয়, নিজের এমপি প্যাডে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে নালিশ ঠুকেছেন রাজ্যের অন্যান্য অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে। অথচ তাতে একটি বারের জন্যও রোজ ভ্যালির নাম উল্লেখ করেননি!

আরও খবর: ভুবনেশ্বরের কোর্টে তোলা হল, এজলাসেই কেঁদে ফেললেন তাপস পাল

এগুলোকেই ‘ষড়যন্ত্রের’ অঙ্গ হিসেবে দেখছেন গোয়েন্দারা। এক সিবিআই-কর্তার কথায়, ‘‘মানুষের টাকা নিয়ে ফেরত না-দিয়ে রোজ ভ্যালির নানা কোম্পানিতে ঢালা হয়েছে। এমনই এক কোম্পানি ফিল্ম ডিভিশনের ডিরেক্টর ছিলেন তাপস পাল। দুর্নীতিতে উনি নিজের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।’’ অভিযোগ— ডিরেক্টর থাকাকালীন তাপস মাসিক বেতনের বাইরেও বিভিন্ন সময়ে সংস্থা থেকে প্রচুর নগদ টাকা নিয়েছেন, যার অঙ্ক দশ কোটির বেশি। নিজের নামে তো বটেই, ওই টাকা তিনি বিভিন্ন লোকের নামে হরেক অ্যাকাউন্টে জমা করেছেন বলে সিবিআইয়ের দাবি। রোজ ভ্যালি-কাণ্ডে উঠে এসেছে সাংসদ-পত্নী নন্দিনীর নামও। অভিযোগ, লগ্নিসংস্থাটির এক চ্যানেলে নন্দিনী পাল নিয়মিত অনুষ্ঠান করেছেন। সেই খাতেও ওঁদের সংসারে বেশ কিছু টাকা ঢুকেছে।

শুক্রবার দুপুর বারোটায় স্ত্রীকে নিয়েই সিবিআই দফতরে ঢুকেছিলেন তাপস। তিনি রোজ ভ্যালি থেকে কবে কত টাকা নিয়েছেন, সব তথ্য ততক্ষণে গোয়েন্দাদের হাতে মজুত। সিবিআই সূত্রের খবর: প্রথম দফার জেরায় তাপস অধিকাংশ তথ্য অস্বীকার করেন। খানিক বিরতি দিয়ে তাঁর সামনে সমস্ত প্রামাণ্য নথিপত্র হাজির করা হয়। ‘‘তখন উনি চুপ করে যান।’’— বলেন এক তদন্তকারী। সাংসদ হওয়ার সুবাদে রোজ ভ্যালিকে অনৈতিক সুবিধে পাইয়ে দেওয়া, নেতাদের সঙ্গে সংস্থার যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া, বিভিন্ন নেতার নাম করে গৌতম কুণ্ডুকে ব্ল্যাকমেল, সিনেমা রিলিজের আগে প্রভাবশালীদের এনে পার্টি করা— তাপসের বিরুদ্ধে এমন নানা অভিযোগও তাঁর সামনে পেশ করা হয়। তিনি রা কাড়তে পারেননি বলে সিবিআই জানিয়েছে। তাদের বক্তব্য, গত বছর পুজোর আগেও তাপসকে এক বার ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু তখন ওঁর বিরুদ্ধে তদন্তকারীদের হাতে এত ‘অকাট্য’ তথ্য-প্রমাণ ছিল না।

এমতাবস্থায় দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ সিবিআই সিদ্ধান্ত নেয়, তাপসকে গ্রেফতার করা হবে। বিকেলে বিধাননগর হাসপাতাল থেকে ডাক্তারেরা এসে তাঁর শারীরিক পরীক্ষা করে যান। তাপস গ্রেফতার হওয়ার পরে নন্দিনী সিবিআই অফিস থেকে বেরিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘‘আমার স্বামীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক চক্রান্ত হয়েছে।’’

আর চন্দননগর থেকে তাপসের বোন পাপিয়া পাল বায়েনের প্রতিক্রিয়া, ‘‘বোন হিসেবে কখনওই চাইব না, দাদার খারাপ কিছু হোক। তবে এ সব ঘটনা সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই।’’

দাদার কীর্তি, সিবিআইয়ের অভিযোগ

• সাংসদ হয়েও রোজ ভ্যালির পরামর্শদাতা হিসেবে বেতন

• সংস্থার ফিল্ম ডিভিশনের ডিরেক্টর হিসেবেও বেতন

• উপরন্তু সংস্থা থেকে ১০ কোটি টাকার বেশি নগদ প্রাপ্তি

• সাংসদ পদ ব্যবহার করে সংস্থাকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়া

• রোজ ভ্যালি বাদে নানা লগ্নিসংস্থার নামে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি

• আমজমনতার টাকা নয়ছয়ের ষড়যন্ত্রে সামিল

• নেতাদের সঙ্গে রোজ ভ্যালির যোগাযোগের মাধ্যম

• বিভিন্ন লোকের নামে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে টাকা সরানো

অন্য বিষয়গুলি:

Tapas paul Rose Valley scam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE