বাংলায় বিজেপির অগ্রগতি যখন থমকে গিয়েছে, সেই সময়ে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্য আলোড়ন ফেলে দিয়েছে দলের অন্দরে! বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার সোমবারই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, দলের বর্ধিত রাজ্য কার্যনির্বাহী বৈঠকে বিরোধী দলনেতা যা বলেছেন, দল তা অনুমোদন করে না। শুভেন্দু যা বলেছেন, তা তাঁর ‘ব্যক্তিগত মত’। কিন্তু বিজেপি শিবিরে বড় অংশই মনে করছে, রাজ্যে দলকে আবার এগোতে হলে হিন্দু ভোটে মনোনিবেশ করা ছাড়া আপাতত পথ খোলা নেই। তাই শুভেন্দু ঠিক কৌশলই নিয়েছেন। আবার অন্য একাংশের আশঙ্কা, খোলাখুলি ভাবে বিরোধী দলনেতা যে ‘বিভাজন’ উস্কে দিয়েছেন, তার জেরে তৃণমূল স্তরে কাজ করা কর্মীদের আরও মারের মুখে পড়তে হতে পারে।
লোকসভা ভোট ও চার কেন্দ্রের বিধানসভা উপনির্বাচনে ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি। তার পরে রাজ্য বিজেপির প্রথম বর্ধিত সভায় শুভেন্দু বলেছিলেন, ‘‘এর পর থেকে বলব, যাঁরা আমাদের সঙ্গে থাকবেন, আমরা তাঁদের সঙ্গে থাকব!’’ দলের সংখ্যালঘু মোর্চারও কোনও প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। বিরোধী দলনেতা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ মন্ত্রের উল্টো সুরে কথা বলছেন, এই প্রশ্নে বিতর্ক বেধেছিল সঙ্গে সঙ্গেই। শুভেন্দু পরে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর স্লোগানকে বাতিল করার কথা তিনি বলতে চাননি। দলের এক জন কর্মী হিসেবে রাজনৈতিক ভাবে তাঁর যা মনে হয়েছে, তা-ই বলেছেন। বিরোধী নেতার বক্তব্য দলের মত নয় বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন সুকান্তও। কিন্তু বিজেপির অন্দরের চর্চায় উঠে আসছে, শুভেন্দুর ওই কৌশলের গ্রহণযোগ্যতা যথেষ্টই। দলের এক বিধায়কের কথায়, ‘‘বিরোধী দলনেতা কোনও অংশের মানুষের মধ্যে বৈষম্য করতে বলেলনি। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, যে অংশের মানুষের সমর্থন আমরা পাচ্ছি, সেই দিকেই আমাদের দল হিসেবে বেশি নজর দিতে হবে। সংখ্যালধুদের সমর্থন যে বিজেপির দিকে নেই, এ তো পরীক্ষিত সত্য!’’
বিতর্ক হলেও তিনি যে তাঁর মূল মত থেকে সরে আসেননি, বৃহস্পতিবার তা বুঝিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং শুভেন্দুও। নন্দীগ্রামে দলীয় কর্মসূচির অবসরে এ দিন ফের তিনি বলেছেন, ‘‘সংখ্যালঘু মোর্চার ভাই-বোনেদের বলব, যাঁরা আমাদের সঙ্গে থাকবেন, আমরা তাঁদের সঙ্গে থাকব।’’ পরে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতির মন্তব্য নিয়ে বিরোধী দলনেতার আরও ব্যাখ্যা, ‘‘সুকান্ত মজুমদার এক দিকে দলের রাজ্য সভাপতি, অন্য দিকে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী। তিনি প্রকাশ্যে মানতে না চাইলেও মনে মনে তাঁকে স্বীকার করতেই হবে! আর আমি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ কথা বলেছি।’’
বিজেপির কিছু নেতাও দ্বিধা ঝেড়ে সরাসরি শুভেন্দুর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। দলের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথাগত রায়ের মতে, ‘‘ওই রকম সত্য কথা জোর গলায় বলার সাহস রাজনীতিতে বেশি লোকের থাকে না!’’ তাঁর এ দিন আরও সংযোজন, ‘‘শুভেন্দু, কাল তুমি যা বলেছো, তা অগণিত বিজেপি কর্মীর হৃদয়ের কথা। আমারও। অভিনন্দন!’’ বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ অর্জুন সিংহেরও মন্তব্য, ‘‘শুভেন্দু যা বলেছেন, তাকে অবশ্যই দু’শো শতাংশ সমর্থন করি!’’
দলে শুভেন্দু-ঘনিষ্ঠ অংশের ব্যাখ্যা, রাজ্যে গত বিধানসভা এবং এ বারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রায় ৩৮% ভোট পেয়েছে। যা পুরোপুরি ‘জল-ছাড়া’, নিখাদ ভোট। এর সঙ্গে আরও ৫-৬% ভোট যোগ করতে পারলে খেলা ঘুরিয়ে দেওয়া সম্ভব। সেই অঙ্কেই হিন্দুত্বের তাসে জোর দিতে চাইছেন শুভেন্দু। ওই অংশের মতে, কলকাতা শহর-সহ বেশ কিছু জায়গায় বিজেপি এই লোকসভা নির্বাচনেও বিজেপি ভাল ভোট পেয়েছে কার্যত কোনও সাংগঠনিক জোর ছাড়া। যাদবপুর, দমদম, বসিরহাট বা মুর্শিদাবাদের মতো কেন্দ্রে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট দেখলে এর আন্দাজ পাওয়া যাবে। তৃণমূল কংগ্রেসের ‘সংখ্যালঘু নির্ভরতা’র উল্টো দিকে কিছুটা হলেও হিন্দু ‘প্রত্যাঘাতে’র ফায়দা বিজেপি পেয়েছে। এই প্রবণতাকেও আরও ধারালো করতে চাইছেন শুভেন্দু।
তবে এই কৌশল বোঝাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর স্লোগানের উল্টো সুর উঠে আসায় কিছুটা পিঠু হটতে হয়েছিল বিরোধী দলনেতাকে। সেই বিড়ম্বনা সামলেও নিজের মত বহাল রেখেছেন তিনি। লোকসভা ভোটে বিজেপির এক প্রার্থীর বক্তব্য, ‘‘সংখ্যালঘুরা কেন বিজেপিকে সমর্থন করেন না, সেই কারণগুলোর উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব তো বিরোধী নেতার নয়। তিনি দলের জোরের জায়গাটাই আরও শক্তিশালী করতে চাইছেন।’’ আবার দলেরই এক নেতা এমনও মনে করছেন, ‘‘মুখে ঘোষণা না করেও আমরা তো মূলত এই কৌশলেই ভোটে লড়ে থাকি। বাংলার যা পরিস্থিতি, তাতে এমন ঘোষণায় আমাদের উপরে আক্রমণ না বেড়ে যায়।’’
শুভেন্দুর মন্তব্য সামনে রেখে বিজেপির মধ্যে ‘দ্বন্দ্ব’ উস্কে দিতে তৎপর রয়েছে তৃণমূলও। শুভেন্দুর ‘পাশে দাঁড়িয়ে’ এ দিন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেছেন, ‘‘শুভেন্দু তো মুখোশ খুলে বিজেপির রাজনীতির মুখই সামনে এনেছেন। যদি তিনি দলের মতাদর্শ-বিরোধী কোনও কথা বলে থাকেন, তা হলে বিজেপি তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন?’’ লোকসভা ভোটে দলের ফল আশানুরূপ না হওয়ার দায়িত্ব নিয়ে বিজেপির অন্দরে টানাপোড়েন খুঁচিয়ে দিতে কুণালের মন্তব্য, ‘‘আসলে বিজেপিতে শুভেন্দুর নখের যোগ্য কেউ নেই! এ রাজ্যে তিনি যত ক্ষণ আছেন, বিজেপি তত ক্ষণই!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy