বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহ। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহের উপর আরও চাপ বাড়ানোর কৌশল নিল বিজেপি। কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে আবারও আদালতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। একই সঙ্গে রাজীবের যোগদান রিপোর্ট (জয়েনিং রিপোর্ট) ফেরত পাঠানোর পদক্ষেপকে ‘স্বাগত’ জানিয়ে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের প্রশংসাও করেছেন তিনি। রাজীবের নিয়োগ সিদ্ধান্ত নিয়ে গত ক’দিন ধরে রাজ্যপালকে বার বার বিঁধেছিলেন শুভেন্দু। এক দিকে রাজ্যপালের প্রশংসা, অন্য দিকে আদালতে যাওয়ার হুমকি— এ ভাবেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনের উপরে বিজেপি ‘জোড়া চাপ’ তৈরি করতে চাইছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাহিনী-বিতর্কের মধ্যেই বৃহস্পতিবার রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধেও কমিশনের কাছে অভিযোগ করেছে বিজেপি। পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণা হওয়ার পর ১০ জন পুলিশ আধিকারিককে বদলি করা হয়েছে। এতে আদর্শ আচরণবিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে দাবি করেছে বিজেপি। তাদের দাবি, ভোট ঘোষণা হওয়ার পর রাজ্যে আদর্শ আচরণবিধি চালু হয়ে যায়। সেই সময় কোনও সরকারি কর্মীকে বদলি করতে পারে একমাত্র কমিশন। এ ক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হয়নি বলেই বিজেপির অভিযোগ। অবিলম্বে ওই বদলির নির্দেশিকা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি দিয়েছেন বিজেপি নেতা শিশির বাজোরিয়া।
প্রথমে ২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছিল রাজ্য। বৃহস্পতিবার আরও ৮০০ কোম্পানি। অঙ্কের হিসাবে যা ৩ হাজার ৭৩৬ শতাংশ গুণ বেশি। পঞ্চায়েত ভোটে প্রথম থেকেই কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে টানাপড়েনের জেরে আদালতে ভর্ৎসনার মুখে পড়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। শেষমেশ আদালতের নির্দেশ মেনেই বৃহস্পতিবার আরও ৮০০ কোম্পানি বাহিনী চেয়েছে কমিশন। কিন্তু তার পরও বাহিনী-বিড়ম্বনা কাটছে না কমিশনের। কারণ, বাহিনী নিয়ে আবার আদালতে যাওয়ার হুঙ্কার দিলেন শুভেন্দু। বৃহস্পতিবার বিরোধী দলনেতা জানিয়েছেন, এখনও অনেক গলদ রয়ে গিয়েছে। সেই গলদ কোথায়, তা দেখিয়ে দিতে তাঁরা আবার আদালতে যাবেন।
আইনি লড়াইয়ে ‘হারের’ পর পঞ্চায়েত নির্বাচনে ‘মাত্র’ ২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন। কিন্তু, এই সংখ্যক বাহিনী চেয়ে বুধবার কলকাতা হাই কোর্টে ভর্ৎসনার মুখে পড়ে কমিশন। ৮২ হাজার আধাসেনা মোতায়েন করতে নির্দেশ দেয় উচ্চ আদালত। সেই মতো বৃহস্পতিবার কেন্দ্রের কাছে আরও ৮০০ কোম্পানি বাহিনী চাইল কমিশন। কিন্তু এর পরও কেন আদালতে যাচ্ছেন শুভেন্দু? বৃহস্পতিবার বিরোধী দলনেতা বলেন, ‘‘২০১৩ সালকে (সে বছরের পঞ্চায়েত নির্বাচন) মান্যতা দিয়ে তার থেকেও বেশি বাহিনীর ব্যবস্থা করার কথা বলেছে আদালত। কারণ, তখন এত বুথের সংখ্যা ছিল না। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির হাল তখন এত খারাপ ছিল না।’’ এই প্রসঙ্গে বিরোধী দলনেতার বক্তব্য, ‘‘এক দফায় ভোটে ৮০০ কোম্পানি বাহিনী যথেষ্ট নয়। বাহিনীর সংখ্যাটা বিষয় নয়। সুষ্ঠু এবং অবাধ ভোট দরকার। আমাদের দাবি, সংখ্যা নিয়ে নয়। সমস্ত বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। ২০১৩ সালের মতো।’’
কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করানোর দাবিতে প্রথম থেকেই সরব বিরোধীরা। পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন-পর্ব ঘিরে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় প্রাণহানি, রক্তপাত, বোমাবাজি, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এই আবহে রাজ্যের সব জেলাতেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্ট। প্রথমে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব জানিয়েছিলেন, আদালতের নির্দেশ মতোই পদক্ষেপ করা হবে। কিন্তু পরে সেই অবস্থান বদল করে কমিশন। হাই কোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যায় রাজ্য এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশন। গত মঙ্গলবার সেই মামলায় রাজ্য এবং কমিশনের আবেদন খারিজ করে হাই কোর্টের নির্দেশই বহাল রেখেছে শীর্ষ আদালত। কিন্তু তার পরও বাহিনী নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটেনি। আদালতের নির্দেশের পরে পঞ্চায়েত ভোটে ২২টি জেলার জন্য ২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছিল কমিশন। বুধবার সেই বাহিনী চাওয়া নিয়ে হাই কোর্টের ভর্ৎসনার মুখে পড়ে কমিশন। পঞ্চায়েত ভোটের জন্য রাজ্যে অন্তত ৮২ হাজার কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানকে আনতে নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। সেই মতো বৃহস্পতিবার কেন্দ্রের কাছে ৮০০ কোম্পানি বাহিনী চেয়েছে কমিশন। জানানো হয়েছে, রাজ্যে মোট ৮২২ কোম্পানি বাহিনী আসছে। এই আবহে শুভেন্দু আবার আদালতের দ্বারস্থ হলে, বাহিনী ঘিরে টানাপড়েন নতুন মাত্রা পেতে পারে বলেই ধারণা।
কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে ক্রমাগত রাজ্য এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনেকে ‘চাপে’ রাখার কৌশল নিয়েছে বিজেপি। বাহিনী নিয়ে সেই কৌশলই বজায় রাখতে চাইছে পদ্মশিবির। পাশাপাশি রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে রাজীব সিংহের নিয়োগ নিয়ে গোড়া থেকেই ‘আপত্তির’ কথা জানিয়েছেন শুভেন্দু। রাজীবকে নিয়োগ করা নিয়ে রাজ্যপাল বোসকেও আক্রমণ করেছেন বার বার। তিনি এ-ও বলেছেন, ‘‘এই কমিশনার মুখ্যমন্ত্রীর নিজের লোক। রাজ্যপালের সঙ্গে সমঝোতা করে একে বসানো হয়েছে। ওঁকে কিছু বলা আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করা একই বিষয়।’’ পঞ্চায়েত ভোটে মনোনয়ন-পর্বে অশান্তির ঘটনাতেও রাজ্যপালকেই বিঁধেছিলেন শুভেন্দু। তবে রাজনীতিতে নানা পট পরিবর্তন ঘটে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। মনোনয়ন-পর্বে অশান্তির পরই কড়া বিবৃতি দিয়েছিলেন রাজ্যপাল। ভাঙড় এবং ক্যানিংয়ে হিংসা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন বোস। তার পরই বুধবার রাতে রাজীবের যোগদান রিপোর্ট ফেরত পাঠান রাজ্যপাল। যা ঘিরে সরগরম রাজ্য রাজনীতি। রাজীবের বিরুদ্ধে রাজ্যপালের এ হেন পদক্ষেপকে ‘ইতিবাচক’ হিসাবেই দেখছেন একদা ‘সমালোচক’ শুভেন্দু। বৃহস্পতিবার উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁয় বিরোধী দলনেতা বলেছেন, ‘‘রাজ্যপাল অত্যন্ত সজ্জন মানুষ। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারা ভুল পথে চালিত (মিসগাইড) হয়েছিলেন। এখন তিনি বুঝতে পেরেছেন, মুখ্যমন্ত্রী একজন মিথ্যাবাদী। তিনি যে পদক্ষেপ করেছেন, বিরোধী দলনেতা হিসাবে স্বাগত জানাচ্ছি। আশা রাখি, আগামী দিনে আরও দৃঢ় পদক্ষেপ করবেন।’’ যদিও যোগদান রিপোর্ট ফেরত প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার রাজীব বলেছেন, “এমন কোনও তথ্য পাইনি।” এই বিতর্কে মুখ খুলেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বিরোধী দলের বৈঠকে যোগ দিতে বৃহস্পতিবার পটনা রওনা দেওয়ার আগে মমতা বলেন, ‘‘আমাদের কাছে এমন কোনও তথ্য নেই (জয়েনিং রিপোর্ট ফেরত আসার)। জীবনে এ রকম হয়নি। উনি (রাজ্যপাল) শপথবাক্য পাঠ করিয়েছিলেন। সবটাই পদ্ধতি মেনে হয়েছে। এমন নয় যে, জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে সরাতে হলে বিচারপতিদের মতো করতে হবে। ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে সরাতে হবে। এটা এত সহজ নয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy