আব্দুল মান্নানের সঙ্গে সুব্রত মুখোপাধ্যায় ফাইল চিত্র
সিনেমার গল্প করবি না! সিগারেট খাবি না! ছাত্র আন্দোলন কী ভাবে করবি? এমনটাই বলতেন সুব্রতদা। ভাবতে পারিনি এমন দিন আসবে, যে দিন সুব্রতদা নেই, আর তা নিয়ে আমাকে লিখতে হবে। সেই ১৯৭০ সাল থেকে আমাদের পরিচয়। সেই সময় সুব্রতদা ছাত্র পরিষদের রাজ্য সহ-সভাপতি। বর্ধমানের কোর্ট চত্বরে খুন হলেন কংগ্রেসের ছাত্রনেতা গুণমণি রায়। সেই ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলন করতেই বর্ধমান যাচ্ছিলেন সুব্রতদা। আমি তখন ছাত্র পরিষদ করি। সে দিনই বালিতে কংগ্রেস নেতা তরুণকান্তি ঘোষের সঙ্গে বৈঠক করতে এসেছিলেন। সেখানে আমার সঙ্গে প্রথম আলাপ। তারপর কত পথ চলা আমাদের। অবশ্যই সেই পথে ছিলেন সঙ্গী প্রিয়দাও। প্রিয়-সুব্রত জুটির দুর্বার আন্দোলনের সাক্ষী আমরা। তাঁদের নেতৃত্বে আন্দোলনে যেমন ছিল আনন্দ, তেমনই ছিল উদ্দাম। সেই সময় কলকাতায় আমার যাতায়াত শুরু হয় ছাত্র আন্দোলনের সুবাদে। মহাজাতি সদনে ছিল ছাত্র পরিষদের সদর দফতর। ফলে সেখানেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রিয়দা এবং সুব্রতদার সঙ্গে কাটিয়েছি কত দিন। সেই সব দিন আজ খুব মনে পড়ছে।
১৯৭০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর কুমার সিংহ হলে সুব্রতদার সঙ্গে লক্ষ্মীকান্ত বসুর লড়াই হল ছাত্র পরিষদের সভাপতি পদে। দু’দিনের সম্মেলন শেষে ২৫ সেপ্টেম্বর ছাত্র পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হলেন সুব্রতদা। ১৯৭১ সালে প্রথম বারের জন্য বালিগঞ্জ থেকে বিধায়ক হলেন। ১৯৭২ সালে ফের বালিগঞ্জ থেকে জিতে মন্ত্রী হন। অল্প বয়সে মন্ত্রী হলেও ছাত্র আন্দোলন থেকে এতটুকু মন সরেনি তাঁর। কিন্তু কাজের ব্যস্ততার জন্য ১৯৭৩ সালে ছাত্র পরিষদের সভাপতি পদ ছেড়ে দেন সুব্রতদা। সভাপতি হন কুমুদদা (কুমুদ ভট্টাচার্য)। নিজে সিগারেট খেতেন না সুব্রতদা, প্রিয়দাও তাই। কিন্তু কোনও দিন কাউকে নিজেদের সামনে সিগারেট খেতে বারণ করতেন না। বরং সুব্রতদা বলতেন, সিনেমার গল্প করবি না! সিগারেট খাবি না! ছাত্র আন্দোলন করবি কী ভাবে?
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর যখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন প্রিয়দা এবং সুব্রতদার সঙ্গে প্রতিবাদ মিছিলে হেঁটেছি। কলকাতায় অধুনা বাংলাদেশের হাইকমিশনারের দফতর তখন পাকিস্তানের। সেই অফিসে গিয়ে ডেপুটেশন দিয়েছি। সংবেদনশীল বিভিন্ন বিষয়ে বার বার সুব্রতদার নেতৃত্বে আমরা পথে নেমেছি। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। এমন নজির বোধহয় দেশে আর নেই। তার পর ১৯৭৭ সালে যখন কংগ্রেস পরাজিত হল, অনেকেই দল ছেড়ে নতুন দলে গেলেন। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির মতো নেতাও তখন কংগ্রেস ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। সেই সময় যাঁরা কংগ্রেসের হাল ধরেছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রণব মুখোপাধ্যায়, বরকত গনিখান চৌধুরী, সোমেন মিত্র এবং সুব্রতদা। হয়তো প্রত্যেকের এ বার দেখা হবে!
১৯৮২ সালের ভোটে সুব্রতদা জোড়াবাগান আবার থেকে বিধায়ক হলেন। এ বার আমিও আরামবাগ থেকে প্রথম বার জিতে বিধায়ক হলাম। সেই সময় সুব্রতদা হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন, কী ভাবে পরিষদীয় রাজনীতি করতে হয়। কী ভাবে প্রশ্ন করতে হয়, কী ভাবে বিতর্কে অংশ নিতে হয়, কী ভাবে শাসকদের আইন অনুযায়ী বিপদে ফেলা যায়। সেই সব কিছুই অল্প সময়ের মধ্যে শিখিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। যা আমার পরবর্তী সময়ে কাজে লেগেছে। আগে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের সামনেও বিরোধীরা বিক্ষোভ দেখাতে পারত। সেই সময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে পুলিশের চোখে চোখ রেখে আন্দোলন করতে বলতেন। এক কথায় বলতে গেলে প্রকৃত নেতা ছিলেন সুব্রত দা।
দলবদল করেছেন একাধিক বার। কিন্তু, আমাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে তার আঁচ পড়েনি। তৃণমূলের বিধায়ক হলেও, কংগ্রেস বিধায়কদের ঘরে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতেন। তিনিই সাম্প্রতিক কালের কলকাতার সেরা মেয়র এ কথা তাঁর শত্রুরাও স্বীকার করতে বাধ্য। কোনও কাজ কী ভাবে করলে তা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনো যায়, সে বিষয়েও স্পষ্ট ধারণা ছিল তাঁর। তাই তো সফল মেয়র হিসাবে দাগ কেটে গিয়েছেন তিনি, তা শহর কলকাতায় চিরকাল থেকে যাবে। সুব্রতদা মেয়র থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে আমাদের আড্ডা ছিল অন্য মাত্রায়। প্রয়াত রাজীব দেব ছিলেন তাঁর অধীনে মেয়র পরিষদ। সেই অফিসেই ছিল আমাদের আড্ডার জায়গা। বিস্তর খাওয়া দাওয়া হত সেখানে। আজ সেই আড্ডার দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে। তার পরই সুব্রতদা তৃণমূল ছেড়ে কংগ্রেসে ফিরে এসেছিলেন। সেই সময় এক সঙ্গে দল করেছি। আবার তৃণমূলে ফিরে গিয়ে মন্ত্রীও হয়েছিলেন। সেখানেও রেখেছিলেন দক্ষতার ছাপ।
২০১৬ সালে আমি বিধানসভার বিরোধী দলের নেতা হলাম। সেই সুবাদে পাঁচ বছর লড়াই করেছিলাম সুব্রতদার সঙ্গে। তাঁর শেখানো শিক্ষায় তাঁকে জবাব দিয়ে চুপ করিয়ে দিতাম। আবার কখনও তিনিও আমাকে জবাব দিতেন তাঁর নিজস্ব কায়দায়। পাঁচ বছর তাঁর বিরুদ্ধে থাকলেও ব্যক্তিগত জীবনে সেই ছাপ পড়েনি কখনওই। বিধানসভায় অধিবেশন চলাকালীন আমি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে, নিয়মিত খোঁজ রাখতেন। এ বার যখন সুব্রতদার শরীর খারাপ হল, তখন নিয়মিত খবর নিয়েছি। কিন্তু, ভাবিনি আমার সঙ্গে আর তাঁর দেখা হবে না। করোনা সংক্রমণের কারণে হাসপাতালে দেখা করতে যাইনি। ভেবেছিলাম বাড়ি ফিরলে দেখা করতে যাব। সেরে আসব বিজয়ার প্রণাম। কিন্তু আজ সুব্রতদাকে দেখতে যাচ্ছি, অথচ তাঁর সঙ্গে কথা হবে না। প্রণাম করব দাদাকে, আমার নেতাকে। তবে বিজয়ার নয়, শেষ প্রণাম।
অনুলিখন - অমিত রায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy