হস্টেলে হামলার সময়ে ভাঙা উইকেট হাতে অচিন্ত্য বাগদি। পাশে সাবের আলি। (ডান দিকে) পিয়ার্সন মেমোরিয়াল হাসপাতালে আহত ছাত্র স্বপ্ননীল মুখোপাধ্যায়। (নীচে) বৃহস্পতিবার বোলপুর কিসান মান্ডিতে গ্রেফতার হওয়ার আগে অচিন্ত্য (বাইকের সামনে) ও সাবের। ছবি: ভিডিয়ো ফুটেজ, বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী ও বাসুদেব ঘোষ
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাঁচে বুধবার রাতের অন্ধকারে বিশ্বভারতীর বিদ্যাভবন বয়েজ় হস্টেলে ঢুকে ছাত্রদের উপরে হামলার ঘটনায় মূল অভিযুক্তদের মধ্যে দু’জনকে বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করেছে জেলা পুলিশ। অচিন্ত্য বাগদি এবং সাবের আলি নাম ওই দুই অভিযুক্তকে বোলপুরের কিসান মান্ডি থেকে ধরা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টা, গুরুতর আঘাত হানা-সহ একাধিক জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে। ধৃতদের বোলপুর আদালতে তোলা হলে তাঁদের ৯ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক। বীরভূমের পুলিশ সুপার শ্যাম সিংহ জানিয়েছেন, এফআইআরে তিন জনের নাম ছিল। আর এক অভিযুক্ত সুলভ কর্মকার এখনও অধরা।
অচিন্ত্য ও সাবেরের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে চাপানউতোর শুরু হয়েছে। এসএফআই-এর দাবি, দু’জনেই এবিভিপি-র সদস্য। এবিভিপি তা অস্বীকার করেছে। অচিন্ত্যরও দাবি, তিনি বরাবর তৃণমূল করেছেন। এসএফআই এবং এবিভিপি চক্রান্ত করে এই ঘটনায় তাঁদের নাম জড়িয়েছে। তৃণমূল এ দিন টুইট করে ছাত্রদের উপরে হামলার নিন্দা করেছে। দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিযোগ্য ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছে প্রশাসনকে।
এবিভিপির তরফে এ দিন বলা হয়, টিএমসিপি সদস্যেরা এসএফআইয়ের সদস্যদের মারধর করলেও এবিভিপি-কে কালিমালিপ্ত করার জন্যই তাদের নামে অভিযোগ আনা হয়েছে।
আরও পড়ুন: বিশ্বভারতীতে হামলা চালাল কারা, পরিচয় নিয়ে তরজা
কিন্তু, বিশ্বভারতীর সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বড় অংশের অভিযোগ, বিজেপি সমর্থিত সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তের বিরুদ্ধে ক’দিন আগে ক্যাম্পাসে যে-বিক্ষোভ হয়েছিল, সেই আক্রোশ থেকেই এই আক্রমণ। এসএফআইয়ের দাবি, গোটা দেশে ছাত্রদের বিরুদ্ধে যে-যুদ্ধ ঘোষণা করেছে বিজেপি সরকার, এ তারই অঙ্গ। পাশাপাশি, হামলার ঘটনায় উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীকেই দায়ী করে বৃহস্পতিবার ক্যাম্পাসে স্লোগান দেন পড়ুয়ারা। তাঁদের অভিযোগ, অচিন্ত্য ও সাবের উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ।
কী হয়েছিল বুধবার?
বিশ্বভারতীর ছাত্র জয়দীপ সাহা, সোমনাথ সৌ বলেন, ‘‘সিএএ-র সমর্থনে সাংসদের বক্তৃতার বিরুদ্ধে আমাদের বিক্ষোভ এবং বিভিন্ন সময়ে উপাচার্যের নানা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন নিয়ে অচিন্ত্যদের মূল রাগ ছিল। সেই রাগেই বুধবার সকাল থেকে আন্দোলনে যুক্তদের হুমকি দেওয়া হচ্ছিল।’’ ছাত্রছাত্রী ঐক্য মঞ্চের কিছু সদস্যের দাবি, অচিন্ত্য, সাবের বিকেলে হস্টেলে আসেন আন্দোলনের অন্যতম মুখ অংশুক মুখোপাধ্যায়কে খুঁজতে। তাঁকে না-পেয়ে রুমমেটটকে শাসিয়ে যান। রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ অংশুকের খোঁজ নিতে হস্টেলের দিকে যাচ্ছিলেন দেবব্রত নাথ, স্বপ্ননীল মুখোপাধ্যায়-সহ তিন পড়ুয়া। হস্টেলের সামনে তাঁদের পথ আটকান অচিন্ত্য, সাবের, সুলভরা। দেবব্রত বলেন, ‘‘ওরা আমাদের বলে, এত রাতে এখানে কী করছিস? তোরা তো হস্টেলে থাকিস না!’’ শুরু হয় বচসা। অভিযোগ, স্বপ্ননীলকে পেরেক লাগানো কাঠের বাটাম দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। সঙ্গে কিল-চড়-ঘুষি। দেবব্রতের দাবি, অচিন্ত্যরা তাঁকে উইকেট দিয়ে পেটান। সঙ্গে অকথ্য গালিগালাজ।
আরও পড়ুন: ‘হস্টেলে ঢুকেছিস কেন, বলে মার শুরু’
নিরাপত্তারক্ষীরা এসে দু’পক্ষকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। যদিও তাঁদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ছাত্রেরা। একই সঙ্গে রাতে পুলিশকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা আসেনি বলে অভিযোগ। এ প্রসঙ্গে পুলিশ সুপারের বক্তব্য, ‘‘বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ ওই ঘটনার বিষয়ে লিখিত বা মৌখিক ভাবে আমাদের কিছু জানাননি। তাঁরা না-চাইলে ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকতে পারে না।’’
হামলার খবর পেয়ে হস্টেলে চলে আসেন একাধিক অধ্যাপক। আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। অভিযোগ, সেখানেও তাড়া করে যায় হামলাকারীরা। ঘিরে ফেলা হয় ছাত্র-অধ্যাপকদের। ফের এক প্রস্ত মারধর হয়। ফ্যাকাল্টি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুদীপ্ত ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আমরা থামাতে গেলে আমাদের গালিগালাজ করা হয়। যে কোনও বিরুদ্ধ মতকে দাবিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা চলছে বিশ্বভারতীতে। এমনকি আমাদের অফিসেও মঙ্গলবার তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’
স্বপ্ননীলের পিঠে পেরেকের ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল বলে হাসপাতাল সূত্রের খবর। হামলার প্রতিবাদে এ দিন সকাল থেকে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে মুখর হয়ে ওঠে বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস। ছাত্র ঐক্যের ব্যানারে দল বেঁধে পড়ুয়ারা কেন্দ্রীয় দফতরের দরজার সামনে বিক্ষোভ দেখান। উপাচার্যকে ‘বিজেপি-ঘনিষ্ঠ’ বলে অভিযোগ তোলা হয়। উপাচার্য অবশ্য এক বারও অফিস থেকে বেরোননি। উষসী চট্টোপাধ্যায়, মৌমিতা চক্রবর্তীর মতো পড়ুয়ারা বলেন, ‘‘ক্যাম্পাসের মধ্যে ছাত্রদের উপরে বহিরাগতদের নিয়ে এসে হামলা হল। এত বড় ঘটনায় নীরব দর্শক ছিলেন নিরাপত্তা আধিকারিক। কার নির্দেশে এই নীরবতা, সেটা অনুমেয়। উপাচার্যও মুখ খোলেননি। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’’
বিশ্বভারতীর মুখ্য নিরাপত্তা আধিকারিক সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, ‘‘অভিযোগ মিথ্যা। ঘটনার খবর পেয়ে আমি এবং রক্ষীরা দু’পক্ষকে সরিয়ে দিই। আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাই। বাকিদের নিরাপদে হস্টেলে পৌঁছে দেওয়া হয়।’’ বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত জনসংযোগ আধিকারিক অনির্বাণ সরকার বলেছেন, ‘‘দু’দল ছাত্রের মধ্যে লড়াই হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বভারতী কোনও ভাবেই জড়িত নয়। এই ঘটনায় রাজনৈতিক কোনও রং নেই।’’ ধৃত অচিন্ত্য ও সাবের উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ বলে যে অভিযোগ উঠেছে, সে সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, ‘‘সব ছাত্রছাত্রীই উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ। তবে, ক্যাম্পাসের মধ্যে কোনও বিশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ বরদাস্ত করবেন না।’’
যাঁর বক্তৃতায় বাধা দেওয়া নিয়ে এত কিছু বলে অভিযোগ, সেই স্বপন দাশগুপ্তের মন্তব্য, ‘‘খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এটা ছাত্র-সংঘর্ষের ঘটনা। দু’পক্ষই তৃণমূল ‘টাইপ’! ওখানে এবিভিপি-র কিছু নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy