Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

রাজ্য জুড়ে একই ছবি, টেট নিয়ে দুর্ভোগ চলছেই

অব্যবস্থা, পুলিশের লাঠি এবং দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া—প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের (টেট) পরীক্ষায় বসতে ইচ্ছুকদের দুর্ভোগের ছবি বদলাল না শুক্রবারেও। ফর্ম তুলতে গিয়ে গত ক’দিন ধরে হয়রান জনতার পক্ষে আশ্বাসের কথা— রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন রাতে জানিয়েছেন, আজ, শনিবার লাইনে দাঁড়িয়েও যাঁরা ফর্ম হাতে পাবেন না, তাঁরা একটি ‘স্লিপ’ পাবেন।

টেটের ফর্ম তোলাকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলা। চলল পুলিশের লাঠি। বহরমপুরে। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

টেটের ফর্ম তোলাকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলা। চলল পুলিশের লাঠি। বহরমপুরে। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

নিজস্ব প্রতিবেদন শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৫ ০৩:৫৯
Share: Save:

অব্যবস্থা, পুলিশের লাঠি এবং দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া—প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের (টেট) পরীক্ষায় বসতে ইচ্ছুকদের দুর্ভোগের ছবি বদলাল না শুক্রবারেও। ফর্ম তুলতে গিয়ে গত ক’দিন ধরে হয়রান জনতার পক্ষে আশ্বাসের কথা— রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন রাতে জানিয়েছেন, আজ, শনিবার লাইনে দাঁড়িয়েও যাঁরা ফর্ম হাতে পাবেন না, তাঁরা একটি ‘স্লিপ’ পাবেন। ওই ‘স্লিপ’ দেখালে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র থেকে পরের বুধবার থেকে ফর্ম মিলবে। তবে এই আশ্বাস এলেও রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় হয়রানির অভিযোগ ওঠা বন্ধ হয়নি।

পরীক্ষায় বসতে ইচ্ছুকদের একটা বড় অংশের ক্ষোভ, যথাযথ পরিকল্পনার অভাবেই টেট-এর ফর্ম বিলি ঘিরে এই ‘অব্যবস্থা’। পার্থবাবু অবশ্য তা মানতে নারাজ। তাঁর দাবি, ফর্ম সংগ্রহ করতে গিয়ে রাজ্যের কোথাও বিশৃঙ্খলা হয়েছে বলে তাঁর জানা নেই। তবে ফর্ম তুলতে যাওয়া জনতার অভিজ্ঞতা অন্য রকম।

উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুর যেমন। এ দিন লাইনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়েও ফর্ম তুলতে না পেরে ইসলামপুর থানার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় জাতীয় সড়ক অবরোধ করে জনতা। র‌্যাফ লাঠি চালায়। লাঠির ঘায়ে এবং পালাতে গিয়ে নর্দমায় পড়ে জখম হন অনেকে। যদিও পুলিশের দাবি, লাইন ঠিক করতে লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করা হয়েছিল। মারধর করা হয়নি।

আলিপুরদুয়ার জংশন রেলওয়ে ইনস্টিটিউট হলের সামনে এ

দিন কয়েক হাজার জন লাইন দিয়েছিলেন। কিন্তু কোথায়, ক’টি কাউন্টার হবে জানতেন না কেউ। বেলা সাড়ে ১০টা নাগাদ প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের তরফে ফর্ম বিলি শুরু হলে লাইন ভেঙে ফর্ম নেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে। সে সময় প্রায় পঞ্চাশ জন অসুস্থ হয়ে পড়েন। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান সমীর নার্জিনারির মন্তব্য “সুষ্ঠু

ভাবে ফর্ম বিলি করতে পুলিশের যতটা সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন ছিল,

ততটা তাঁরা হননি।” অভিযোগ মানেনি পুলিশ।

পুলিশ লাঠি চালিয়েছে বহরমপুর এবং কলকাতাতেও। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের গোরাবাজার শাখার সামনে সকাল থেকে লাইন দিয়েছিলেন লেকটাউন, দমদম, দমদম ক্যান্টনমেন্ট, বিরাটি থেকে আসা পরীক্ষায় বসতে ইচ্ছুকেরা। সে লাইন দমদম সেন্ট্রাল জেল পর্যন্ত চলে যায়। বিকেল ৩টের পরে ফর্ম বিলি বন্ধ হলে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে জনতা। তারপরেই পুলিশ লাঠি চালায়।

বহরমপুরে তিন দফায় লাঠি চালায় পুলিশ। শহরের প্রাণকেন্দ্র গ্রান্ট হল মোড় লাগোয়া ব্যাঙ্কে ফর্ম শেষ হয়ে যায় বিকেল সওয়া ৩টে নাগাদ। ফর্ম শেষ হয়ে গিয়েছে শুনে লাইনে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত অনেকে খেপে ওঠেন। ঢিল মেরে ভাঙা হয় ব্যাঙ্কের জানলার কাচ, ব্যাঙ্কের নাম লেখা গ্লোসাইন বোর্ড। পুলিশ লাঠি চালিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। এ দিন বিকেল ৫টা নাগাদ স্বরূপনগরের তেঁতুলিয়ায় ফর্ম বিলি বন্ধ হতে লাইনে দাঁড়ানো লোকজন ব্যাঙ্কের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেন। হয় পথ অবরোধ।

লাঠি চালানোর পাশাপাশি অন্য অভিযোগও উঠছে। বৃহস্পতিবার, বসিরহাটে সাদা পোশাকে থাকা এক আইআরবি জওয়ান আগ্নেয়াস্ত্র বার করে পরীক্ষায় বসতে ইচ্ছুকদের দিকে তেড়ে গিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। তাতে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। ওই জওয়ানের অবশ্য দাবি, জনতা তাঁকে মারধর করছিল। প্রাণে বাঁচতেই তিনি রুখে দাঁড়ান।

টেট-এর ফর্ম তোলার লাইনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এ দিন অন্তত ২০ জন অসুস্থ হয়ে পড়েন রানাঘাটে। লম্বা লাইনে ঠেলাঠেলির সময়ে রাস্তার পাশের একটি দোকানের বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে শ্রাবণী দাস নামে এক তরুণী তড়িদাহত হন।

অব্যবস্থার অন্য ছবি আবার দেখা গিয়েছে কৃষ্ণনগর এবং শিলিগুড়িতে। কৃষ্ণনগরের পাত্রবাজারে ব্যাঙ্কের শাখায় ফর্ম তোলার লাইনে রীতিমতো ‘জায়গা’ বিক্রি হয়েছে। দর ঘোরাফেরা করেছে সাতশো থেকে এক হাজার টাকা। এক তরুণীর স্বীকারোক্তি, ‘‘লাইনে জায়গা রেখে দেবে বলে এক দাদা হাজার টাকা চেয়েছিল। অনেক বলে কয়ে সাতশো টাকায় রাজি করিয়েছি।’’ শিলিগুড়িতে আবার তৃণমূলের এক প্রভাবশালী নেতার এক অনুগামী ব্যাঙ্ক থেকে ফর্ম তুলে এনে বাইরে বিলি করছেন বলে অভিযোগ। শিলিগুড়ির তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন।

এর পরেও টেট-এর ফর্ম বিলি নিয়ে কোনও সমস্যা হচ্ছে না বলবেন? শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘‘গোটা পরিস্থিতির জন্য দায়ী ভুল বোঝাবুঝি।’’ কীসের ভুল বোঝাবুঝি? পার্থবাবুর কথায়, ‘‘যাঁদের ফর্ম তোলার প্রয়োজন নেই, তাঁরাও আবার ফর্ম তুলছেন।’’

শিক্ষা দফতর সূত্রের দাবি, ২০১২ সালের টেট পরীক্ষায় যাঁরা বসেছিলেন, তাঁদের কাছে যদি ‘অ্যাকনলেজমেন্ট স্লিপ’ থাকে তা হলে তাঁদের আর এ বার ফর্ম তোলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তাঁরাও ফর্ম সংগ্রহের জন্য লাইন দেওয়ায় সমস্যা বাড়ছে। একই ভাবে ২০১৪ সালে পর্ষদের টেট পরীক্ষার জন্য যাঁরা ব্যাঙ্কে টাকা জমা দিয়েছিলেন, গত মাসেই তাঁদের অনলাইনে অ্যাডমিট-কার্ড সংগ্রহ করতে বলেছিল পর্ষদ। পর্ষদের দাবি, এই সব আবেদনকারীরাও ফের ফর্ম তুলছেন। ফলে, সমস্যা বাড়ছে।

কিন্তু অনেকে ‘অ্যাকনলেজমেন্ট স্লিপ’ বা ব্যাঙ্কে টাকা জমা দেওয়ার রসিদ হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁরাও রয়েছেন ফর্ম তোলার লাইনে। শুক্রবার রাতে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ সূত্রে জানিয়ে দেওয়া হয়, ২০১২ সালের ‘অ্যাকনলেজমেন্ট স্লিপ’ এবং ২০১৪ সালের ব্যাঙ্কে টাকা জমা দেওয়ার রসিদ যাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে কী করণীয়, তা ৮ জুলাইয়ের পরে জানিয়ে দেওয়া হবে। অর্থাৎ, বিষয়টি যে পর্ষদ আগে বুঝতে পারেনি, সে ইঙ্গিত স্পষ্ট।

রয়েছে আরও সমস্যা।

বিকাশ ভবনের একটি সূত্রের দাবি, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের কেন্দ্রীয় দফতর থেকে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের কর্তাদের পুরো বিষয়টি বোঝানো হয়েছিল। কিন্তু তার পরেও চাকরিপ্রার্থীদের কাছে নানা ধোঁয়াশা কেন রয়ে গেল, তা বুঝতে পারছেন না পর্ষদের কর্তারা। পক্ষান্তরে, একাধিক জেলার প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতিদের বক্তব্য, ‘‘সব কিছুই কেন্দ্রীয় ভাবে ঠিক করা হয়েছে। আমাদের সঙ্গে আগাম কোনও আলোচনা হয়নি।’’

ঘনিষ্ঠ মহলে জেলা সংসদ-কর্তাদের অনেকে মানছেন, ‘‘গোড়ায় গলদ থেকে গিয়েছে।’’ তাঁদের ব্যাখ্যা, এ বার এমনিতেই পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বিপুল হওয়ার কথা। কারণ, আবেদনকারীদের বয়সের ঊর্ধ্বসীমা ৪০ বছর। আর উচ্চ মাধ্যমিকে ৫০ শতাংশ নম্বর পেলেই আবেদন করা যাবে। মাপকাঠি যেখানে এমন, সেখানে টেট-এ বসতে ইচ্ছুকের সংখ্যা কত হতে পারে সে বিষয়ে পর্ষদ-কর্তাদের পক্ষে সম্যক অনুমান করা সম্ভব হয়নি। তাই পর্যাপ্ত ফর্ম বিতরণ কেন্দ্রও খোলা হয়নি। বর্ধমানের মতো বড় জেলায় ফর্ম বিলির একটি কেন্দ্র খোলাটাই রাজ্যের শিক্ষা-কর্তাদের তরফে স্পষ্ট ধারণার অভাবের ইঙ্গিত বলে দাবি করছেন জেলা শিক্ষা সংসদের ওই কর্তারা।

এ প্রসঙ্গেই উঠছে সার্বিক ভাবে কেন অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা হল না, সে প্রশ্ন। যদিও পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের যুক্তি, অনলাইনে অ্যাডমিট-কার্ড পেতে বিস্তর সময় লাগত। এ ক্ষেত্রে ফর্ম জমা দিলেই হাতেহাতে অ্যাডমিট-কার্ড পাচ্ছেন পরীক্ষার্থীরা। কিন্তু পরীক্ষায় বসতে ইচ্ছুকদের অভিজ্ঞতা, ফর্ম জমা দেওয়া তো দূর, তুলতেই কালঘাম ছুটছে।

ভ্রম সংশোধন

শুক্রবার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভোর থেকে লাইনে, ফর্ম না পেয়ে বাড়ছে ক্ষোভ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ভুলবশত লেখা হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের টেট পরীক্ষার ফর্ম বিলি হবে ৭ জুলাই পর্যন্ত। আসলে ওই ফর্ম বিলির শেষ দিন আজ, শনিবার ৪ জুলাই। অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য আমরা দুঃখিত ও আন্তরিক ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy