ফাইল চিত্র। সৌমাল্য বিশ্বাস (ইনসেটে)।
টানা ৩৩ ঘণ্টার রাস্তা। ওঠার আগে সেই রকমই জানতাম। কিন্তু যে ভাবে বারবার আমাদের ট্রেন দাঁড়াচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে সময় আরও অনেকটাই বেশি লাগবে। ইউক্রেনের সীমান্তে পৌঁছতেই হয়তো রাত হয়ে যাবে।
দেশে আমাদের যে ট্রেন সেইরকমই আমাদের কম্পার্টমেন্টে একেকটা ভাগে ৬ জনের সিট। কিন্তু আমরা ১৭ জন। এক জনের জায়গায় প্রায় তিন জন বসে আছি। আমাদের মালপত্র, ব্যাগ ইত্যাদিও খুব একটা কম নয়। শোওয়া দূরে থাক, কাল দুপুর থেকে গোটা রাত, তার পর এখনও একটু সোজা হয়ে বসার মতো জায়গা নেই কারও।
একেই বোধহয় বলে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি!
আমরা জ়্যাপরোজ়িয়া মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের কয়েক জন গত কয়েক দিন এ ভাবে নিজেরা দল বেঁধে আছি। কখনও অ্যাপার্টমেন্টে, কখনও কলেজের নীচে তৈরি বাঙ্কারে। সোমবার সকালে আমাদের জ়্যাপরোজ়িয়া শহর ছেড়ে যাওয়ার একটা ‘মেসেজ’ পেয়েছিলাম। আমাদের মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে প্রবাসী ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করেছিলেন রেক্টর। তাঁর সঙ্গে আরও এক অধ্যাপক এবং ভারতীয় এক আধিকারিকও।
বলা হয়েছিল, সকাল ১০ টার মধ্যে এক নম্বর হস্টেলে চলে আসতে। একটা ট্রেন কোনও একটা উজ়গোরঢ সীমান্তের কাছাকাছি নিয়ে যাবে। সেখান থেকে প্রতিবেশী দেশ হয়ে ভারতে ফেরার কথা। পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, জার্মানি, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া— এই রকম একাধিক দেশের সীমানা রয়েছে ইউক্রেনের সঙ্গে। তারই কোনও একটা পেরিয়ে সে দেশে ঢুকতে পারলে ভারত সরকারের ব্যবস্থায় আমরা দেশে ফিরতে পারব। সেখান থেকে আমি পৌঁছব কলকাতায়, বেলেঘাটার বাড়ি। হাঙ্গেরি সীমান্ত দিয়ে আমরা ইউক্রেন ছেড়ে বেরোব।
সকাল ১০ টা থেকে অপেক্ষা করে বেলা ১২ টা নাগাদ ট্রেনটা ছেড়েছিল। এইরকম লম্বা পথ ট্রেনে যাওয়া বেশ মনোরম। তার উপরে চারপাশে জঙ্গল। বরফ পড়ছে। সেই বরফে রাস্তা, গাছপালা সব একটু একটু ঢাকা পড়ছে। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও এ সব ভাল লাগছে না।
একটা উৎকণ্ঠা কাজ করছে। কখন, কোন সীমান্তে পৌঁছে, কোন দেশ হয়ে নিজের দেশে, নিজের শহরে পৌঁছতে পারব. শুধু তা-ই ভাবছি। আবার ভাবছিও না। কারণ ভেবে কিছু বোঝা যাবে না। এই যে রাস্তা, তার কিছুই আমি চিনি না। বাইরে তাকালে সে ভাবে লোক জনও দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে না সে ভাবে গুছিয়ে চলা কোনও শহর। তবে কিছু ‘মুভমেন্ট’ চোখে পড়েছে।
খাওয়ার জল ফুরিয়ে আসছে। সোমবার সকালে সামান্য কিছু খেয়ে ট্রেনে উঠলেও রাতে কিছু খাওয়া হয়নি। ট্রেনেও খাবারের কোনও ব্যবস্থা নেই। তা ছাড়া রাতে গোটা ট্রেনকে অন্ধকার করে রাখতে হয়েছিল। কোথাও কোনও আলো ছিল না। বলে দেওয়া হয়েছিল, ফোনের ফ্ল্যাশলাইটও যেন না জ্বলে। শুধু পাওয়ার ব্যাঙ্কটা হাতের কাছে রেখে ফোনের চার্জটা ঠিকঠাক রাখছি। এ সবের মধ্যে খাওয়ার কথা খুব একটা মনেও পড়েনি।
সকাল থেকে পেটে শুধু চিপস আর জল পড়েছে। বিকেল চারটে নাগাদ আমরা এখন স্টেশনে দাঁড়িয়ে। স্থানীয় ভাষায় নাম পড়ে উঠতে পারছি না। তার পিছনে, পাশে বরফ ঢাকা পাহাড়, বরফ ঢাকা গাছ।
অপেক্ষায় আছি কখন পৌঁছব হাঙ্গেরি সীমান্তে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy