সময় দেখাচ্ছে, সকাল আটটা। গার্ডেনরিচ জাহাজ কারখানা (জিআরএসই)-র এক নম্বর গেট। তার সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ির আনাগোনা নিয়ন্ত্রণ করছে এক ব্যক্তি। রীতিমতো মুরুব্বির মতো তার হাবভাব!
সিসিটিভি’র সেই ফুটেজ দেখে গোয়েন্দাদের চোখ কপালে। কারণ লোকটি যে আর কেউ নয়! স্বয়ং ইরশাদ আনসারি!
পাকিস্তানি চর সন্দেহে ধরা পড়ার সুবাদে ইরশাদ এখন শিরোনামে। চক্রান্তে জড়িত অভিযোগে তার ছেলে আসফাক ও শ্যালক জাহাঙ্গিরও আপাতত পুলিশ হেফাজতে। এবং কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)-এর গোয়েন্দাদের পর্যবেক্ষণ, ইরশাদ-আসফাক-জাহাঙ্গিরের সূত্র ধরেই ক্রমশ আন্দাজ মিলছে যে, এখানে পাক চর-চক্রের শিকড় কতটা গভীর।।
এমতাবস্থায় খাস প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের জাহাজ কারখানার গেটে এ হেন সন্দেহভাজনের দাপুটে আচরণের নমুনা দেখে তদন্তকারীরা বিস্মিত। এটা ঠিক যে, পেশায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ইরশাদ ছিল জিআরএসই-র ঠিকা শ্রমিক। সেই হিসেবে কারখানায় তার উপস্থিতি স্বাভাবিক। ‘‘কিন্তু এক জন কন্ট্রাক্ট লেবার সাতসকালে মেন গেটে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক সামলাচ্ছে, বড়কর্তাদের গাড়ির সামনে গিয়ে সেলাম ঠুকছে, এটা দস্তুরমতো অস্বাভাবিক। ও তো সিকিওরিটি গার্ডের চাকরি করত না!’’— বলছেন লালবাজারের এক অফিসার।
ব্যাপারটা এত দিন কারও নজরে পড়েনি কেন, সেটাও গোয়েন্দাদের ভাবাচ্ছে। বস্তুত কারখানার নিরাপত্তারক্ষী ওশ্রমিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁরা জানতে পেরেছেন, ইরশাদ প্রায় রোজই নিজের ডিউটি শুরুর আগে সকাল আটটা থেকে ন’টা পর্যন্ত স্বেচ্ছায় ‘ডিউটি’ দিত ১ নম্বর গেটে। ঘটনাচক্রে, কারখানার হর্তা-কর্তারা ১ নম্বর দিয়েই যাতায়াত করে থাকেন। তদন্তকারীদের অনুমান, ‘সাহেবদের’ সুনজরে আসার তাগিদেই ইরশাদের ওই ‘স্বেচ্ছাশ্রম।’
এ-ও জানা যাচ্ছে, জাহাজ নির্মাণের প্রক্রিয়া পরিদর্শন করতে দিল্লির অফিসারেরা এলে ইরশাদের তৎপরতা কয়েক গুণ বেড়ে যেত। সব সময় তাঁদের আশে-পাশে থাকার ফিকির খুঁজত। জিআরএসই’র এক নিরাপত্তারক্ষীর কথায়, ‘‘বড়কর্তারা হয়তো গেটের সামনে দাঁড়িয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনা করছেন। ইরশাদকে দেখতাম ঠিক ওঁদের গা ঘেঁষে! এখন মনে হচ্ছে, গেট সামলানোর ভান করে ও খবর জোগাড় করার ধান্দায় থাকত।’’
গোয়েন্দাদের দাবি, গার্ডেনরিচে যুদ্ধজাহাজ নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ের ছবি তোলা ও নির্মাণ সংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্য যে ইরশাদ হস্তগত করে ইতিমধ্যে বিদেশে পাচার করেছে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এখন তার ‘বহুমুখী’ কাজকর্মের নানা সংবাদও প্রকাশ্যে আসছে। কী রকম?
এক গোয়েন্দা-কর্তার ব্যাখ্যা: গত চার বছরে গার্ডেনরিচে জাহাজ উদ্বোধনের সব অনুষ্ঠানে সপরিবার হাজির থেকেছে ইরশাদ। জলে জাহাজ ভাসানো-সহ পুরো অনুষ্ঠানের ছবিও তুলেছে। এ সবের অনুমতি সে কী ভাবে হাসিল করত, কী ভাবে ভিভিআইপি প্রবেশপত্র জোগাড় করত, তদন্তকারীরা তা খতিয়ে দেখছেন। ‘‘প্রাথমিক ভাবে যা জানা যাচ্ছে, শাসকদলের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার দৌলতে ইরশাদ কার্যত বিনা বাধায় কারখানা দাপিয়ে বেড়িয়েছে। তাকে আটকানোর মতো বুকের পাটা রক্ষীদের ছিল না।’’— অভিযোগ এক এসটিএফ-কর্তার।
গোয়েন্দা-সূত্রের খবর: জিআরএসই’তে ইরশাদ কাজে লেগেছিল ২০০৮-এ। প্রথম তিন বছর আইএনটিউসি শ্রমিক ইউনিয়নেরসদস্য ছিল। ২০১১-য় রাজ্যে পালাবদদল ঘটতেই জামা পাল্টে তৃণমূল ইউনিয়নে (আইএনটিটিইউসি) যোগ দেয়। আর তার পরে প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়।
শ্রমিক ও রক্ষীদের অনেকেও জানিয়েছেন, ইউনিয়নের প্রতিপত্তির জোরে ইরশাদ ধীরে ধীরে গোটা কারখানায় প্রভাব কায়েম করেছিল। স্থায়ী-অস্থায়ী প্রতি শ্রমিকের নির্দিষ্ট কাজের এলাকা রয়েছে। কিন্তু অভিযোগ, গার্ডেনরিচ শিপবিল্ডার্সের আইএনটিটিইউসি নেতা শামিম আনসারির ছাতা মাথায় থাকায় ইরশাদের গতি-বিধিতে কোনও রাশ পড়েনি। ‘‘হাতে স্ক্রু-ড্রাইভার আর প্লাস নিয়ে ও পুরো কারখানা চক্কর মারত। কেউ কিছু বলত না।’’— মন্তব্য এক শ্রমিকের। ঠিকা শ্রমিকদের একাংশের এ-ও দাবি: গত চার বছরে ইরশাদ কোনও নির্দিষ্ট কাজ করেনি। এমনকী আইনএনটিটিইউসি-রই কয়েক জন জানিয়েছেন, ইরশাদ মাঝে-মধ্যে নাকি সাত-দশ দিনের জন্য বেপাত্তা হয়ে যেত। অথচ সেই সময়টায় তার হাজিরায় ছেদ পড়ত না!
ইরশাদ সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করতে তদন্তকারীরা এ বার জিআরএসই-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। বিরোধীপক্ষ ইতিমধ্যে রাজনৈতিক আক্রমণ শানাতে শুরু করেছে। কারখানার আইএনটিইউসি নেতা মোক্তার আহমেদের প্রতিক্রিয়া, ‘‘তৃণমূলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে ইরশাদ জাহাজ তৈরির ছবি তুলে পাচার করেছে! ও দেশদ্রোহী। ওর আশ্রয়দাতারাও তা-ই। কড়া শাস্তি দেওয়া উচিত।’’
তৃণমূল ইউনিয়ন কী বলছে?
ইরশাদ প্রসঙ্গ সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছেন আইএনটিটিইউসি নেতা শামিম আনসারি। ‘‘আমি তো কাখানায় সব সময় থাকি না। খবরও রাখি না, কোন শ্রমিক কখন কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।’’— যুক্তি দিয়েছেন তিনি। পরে আবার বলেছেন, ‘‘সব শ্রমিকই আমার পরিচিত। ইরশাদ বিশেষ কেউ নয়।’’
সব মিলিয়ে চরের প্রতিপত্তি নিয়ে দুস্তর ধোঁয়াশা রয়েই যাচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy