এ ভাবেই ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে আলু। সোমবার মিলনমেলায়। নিজস্ব চিত্র
সরকারি হুঁশিয়ারির তোয়াক্কা না করেই সোমবার ধর্মঘটে নামল আলু ব্যবসায়ীদের একটি সংগঠন। যার জেরে আরও টান পড়ল বাজারে। সেই চাহিদা যে পূরণ করবে, এমন কোনও সম্ভাবনাও দেখাতে পারল না সরকার। ধর্মঘট তোলার কোনও চেষ্টা নজরে পড়ল না। আবার মিলনমেলায় আলু মজুত করে বাজারে ১৪ টাকা কেজি দরে বেচার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাতেও দেখা গেল বিস্তর গলদ। প্রশ্ন উঠে গেল, মিলনমেলায় কি আদৌ এ ভাবে আলু মজুত করে রাখা সম্ভব?
অন্য রাজ্যে আলু যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকার যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তার প্রতিবাদে এ দিন কর্মবিরতির ডাক দিয়েছিল আলু ব্যবসায়ীদের একটি সংগঠন। এর ফলে এ দিন পোস্তা বা কোলে মার্কেটের মতো পাইকারি বাজারে হিমঘর থেকে কোনও আলুর গাড়ি আসেনি। ফলে শহরে আলুর জোগান কমেছে। তবে খুচরো বাজারে আগে থেকে কিছু আলু মজুত থাকায় একদম আলু-শূন্য হয়ে পড়েনি শহর।
এ দিন পোস্তা বাজারে আলুর একটি পাইকারি দোকানে গিয়ে দেখা গেল, মাত্র কয়েক বস্তা আলু পড়ে রয়েছে। আলু বিক্রেতা বরুণ মুখোপাধ্যায় বলেন, “হিমঘর থেকে আনা আলুর মজুত প্রায় শেষ। মাত্র কয়েক বস্তা পড়ে রয়েছে।” কোলে বাজারের পরিস্থিতিও একই রকম। পুরসভার বাজারগুলিতে অবশ্য এ দিনও সরকারি দামের আলু নিয়ে ট্রাক এসেছে। কিন্তু আলু বিক্রেতারা তা কিনতে উৎসাহী হননি। তাঁদের বক্তব্য, সরকারি আলুর বেশ কিছু পচা-ধসা থাকছে। তা ছাড়া, বেশি দামের আলু ফেলে ১৪ টাকা কেজির আলু বেচতেও চাইছেন না অনেকে। মানিকতলা বাজারের এক দোকানি বলেন, “যত ক্ষণ বেশি দামে আলু মজুত রয়েছে, তত ক্ষণ কম দামেরটা বেচে লোকসান করব কেন!” গড়িয়াহাট বাজার সমিতির সম্পাদক দিলীপ মণ্ডল অবশ্য জানালেন, তাঁরা সরকারি আলুও বিক্রি করছেন।
কিন্তু সরকারি আলু নিয়েও থাকছে একাধিক অস্বস্তি। ট্রাক আটক করে কম দামে আলু বিক্রি কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে আগেই প্রশ্ন উঠেছে। এ বার মিলনমেলায় সেই আলু মজুত করা নিয়ে তৈরি হল জিজ্ঞাসা।
শিল্প-সহ অন্য নানা মেলার জন্য তৈরি স্থায়ী এলাকা হিসেবে পরিচিত মিলনমেলা। শুধু শিল্পমেলাই নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সেখানে শিল্প সম্মেলনেরও আয়োজন করেছিল। সোমবার সেখানে পা দেওয়ার আগেই নাকে ধাক্কা দিল পচা আলুর গন্ধ! সেই গন্ধ সহ্য করে কোনও রকমে প্রাঙ্গণে ঢুকতেই চোখে পড়ল যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আলু। সে সব চাকার তলায় পিষে গাড়ি ঢুকছে-বেরোচ্ছে। যা দেখে এক আলু ব্যবসায়ী বলছিলেন, “রাজ্যের শিল্প বা কৃষি, কারও জন্যই এই ছবি মোটেই সুখকর নয়।”
পাঁচ দিন আগে হুগলি থেকে ওড়িশা যাওয়ার পথে আরামবাগের এক ব্যবসায়ীর তিনটি আলুর ট্রাক আটকায় পুলিশ। ৯ অগস্ট থেকে তাদের ঠিকানা মিলনমেলা। কিন্তু সোমবারও একই ভাবে আলুবোঝাই হয়ে পড়েছিল ট্রাকগুলি। দুপুরে সেখান থেকে আলু নামানো শুরুর পরেও হা-হুতাশ করছিলেন ওই ব্যবসায়ী, “বাছাই করা আলু প্যাকেট পিছু (৫০ কেজি) ৮৩৭ টাকা দাম কিনেছি। বিক্রি করলে কিছু লাভ হতো। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল!” লোকসান কত? জানালেন, ট্রাক পিছু লক্ষাধিক টাকা। তারকেশ্বরের এক আলু চাষিকে (তিনি ব্যবসায়ীও) পাওয়া গেল মিলনমেলায়। তাঁরও তিনটি ট্রাক আটক করেছে পুলিশ। দু’টি তখনও হেস্টিংসে দাঁড়িয়ে, একটি আনা হয়েছে মিলনমেলায়। স্বভাবতই পিছন পিছন ছুটে এসেছেন তিনি। স্বচক্ষে দেখেছেন কষ্টের ফসল কী ভাবে পিষে যাচ্ছে গাড়ির চাকায়। ছলছল চোখে প্রশ্ন করেন, “এ সবের কি কোনও দরকার ছিল?”
তাঁর ওই প্রশ্ন কার উদ্দেশে, তা স্পষ্ট করেননি ওই চাষি। কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হয় না, আলুর দাম নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজ্য সরকার যে পথ নিয়েছে, অনেক মানুষের মতো তারকেশ্বরের ওই আলু চাষিকেও তা বিস্মিত করেছে। পরিস্থিতির কার্য-কারণ বিশ্লেষণ না করে, শিকড়ের সন্ধান না করে, চটজলদি দাওয়াইয়ের উপরে ভরসা করেছে রাজ্য প্রশাসন। ভিন্ রাজ্যের পথে রওনা দেওয়া আলুর ট্রাক আটক করছে পুলিশ, আবার বাজারে গিয়ে বলা হচ্ছে ১৪ টাকা কেজি-র বেশি দামে আলু বিক্রি করা যাবে না।
মিলনমেলায় আলু মজুত নিয়েও বিস্ময় কম নয়। প্রশ্ন উঠেছে, হিমঘরের সঙ্গে কি এই মজুতের আদৌ কোনও তুলনা হয়?
মিলনমেলায় কর্তব্যরত এক সরকারি অফিসার জানান, হিমঘরে আলু রাখা হয় ১-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা করেও মিলনমেলার হ্যাঙারে সারাক্ষণ ওই তাপমাত্রা বজায় রাখা সম্ভব নয়। তা ছাড়া, বড় বড় চারটি হ্যাঙারে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হলে দিনে লাখ দেড়েক টাকা খরচ হবে। সম্ভবত সে কারণেই হ্যাঙারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা থেকে সরে এসেছে রাজ্য।
কিন্তু তাতে আলুর পচন আরও বাড়বে না? ওই অফিসার অবশ্য মনে করেন, হ্যাঙারগুলিতে যে হেতু এগজস্ট ফ্যান রয়েছে, তাই আলুর খুব একটা ক্ষতি হবে না। তিন-চার দিন ভালই থাকবে। চোখের সামনে আলু পচতে দেখেও এমন বলছেন কী করে? এ বার ওই অফিসারের জবাব, “এর বেশি কিছু বলব না।”
এর মধ্যেই এক কর্মী ওই অফিসারকে জানিয়ে গেলেন, বেহালায় ১২৫ নম্বর ওয়ার্ডে যে আলু বোঝাই গাড়ি পাঠানো হয়েছিল, তা ফেরত এসেছে। কারণ ওই ট্রাকের সব আলু নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পুরসভা সূত্রের খবর, ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর ঘনশ্রী বাগ আলুর হাল দেখেই ফেরত পাঠিয়েছেন। এ দিন বিকেল পর্যন্ত মিলনমেলার দুটি হ্যাঙার ভর্তি হয়ে তিন নম্বর হ্যাঙ্গারে আলু ঢোকানো হয়েছে। সেখানে ঢুকতেও ফের পচা গন্ধ। কয়েকটি প্যাকেটের রঙও বদলে গিয়েছে। পচন দ্রুত ছড়াবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সেখানে হাজির চাষিরাই।
মিলনমেলায় আলু সংরক্ষণে তদারকির দায়িত্ব রাজ্যের কৃষি বিপণন দফতরের। তাঁরা বসে রয়েছেন মিলনমেলার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে। মাঝে মাঝে কেবল লোক পাঠিয়ে হিসেব নিচ্ছেন, ক’টি ট্রাক ঢুকল, আর ক’টি খালি হল। কিন্তু সেই ঢোকা এবং খালি হওয়ার মাঝে কত আলু যে ট্রাকের চাকায় পিষে যাচ্ছে, তার খবর রাখছেন না তাঁরা। এ-ও দেখছেন না যে, ভাল আলুর প্যাকেটের সঙ্গেই গাদাগাদি করে রাখা হচ্ছে পচা আলুর প্যাকেট। ফলে পচন ছড়াচ্ছে।
ওই অফিসেই অন্য টেবিলে রয়েছেন কলকাতা পুরসভার একদল অফিসার। কোন বাজারে কত ট্রাক আলু পাঠানো হবে, সেটা দেখা তাঁদের দায়িত্ব। পুরসভার এক অফিসার জানান, শনিবার ২০ ট্রাক, রবিবার ১৫ ট্রাক এবং সোমবার ৩০ ট্রাক আলু পাঠানো হয়েছে। অথচ সোমবার বিকেল পর্যন্ত ১১১ ট্রাক আলু মিলনমেলায় রাখা হয়েছে। সরকারের বাজেয়াপ্ত করা আলুর চাহিদা এত কম দেখে ভাঁজ পড়েছে ওই অফিসারদের কপালে। এ ভাবে চললে আরও আলু নষ্ট হবে এমন আশঙ্কা তাঁদেরও।
সামগ্রিক ভাবে সরকারি কর্তাদের একাংশ এ-ও মানছেন যে, সরকারি আলুর দাম ১৪ টাকায় বেঁধে দেওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। এ দিনের প্রতীকী ধর্মঘট তাঁদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। যে ভাবে কোনও চাপ বা বাধা ছাড়াই এই ধর্মঘট সফল হল, সে দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যতে আশঙ্কার মেঘ দেখছেন তাঁরা।
যদিও এ সবের কোনওটাই মানতে চাইছেন না সরকারি টাস্ক ফোর্সের সদস্য কমল দে বলেন, “খারাপ মানের আলুর অভিযোগ উঠলে আমরা সেই আলু বদলেও দিয়েছি।” রাজ্যের কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায়েরও দাবি, “সরকারি আলু সব জায়গায় ঢোকেনি বলে যে অভিযোগ, উঠেছে তা ঠিক নয়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy