মিঠুন-খুকুমণির বিয়ে হল আন্দোলনে ব্যারিকেড তৈরি করতে করতে। ফাইল চিত্র ।
মিঠুন বিশ্বাস নদিয়ার চাপড়ার বাসিন্দা। আর পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়ার বাসিন্দা খুকুমণি দোলই। কোথায় নদিয়া। আর কোথায় পূর্ব মেদিনীপুর! তবু মিঠুনের সঙ্গে আলাপ হল খুকুমণির। আলাপ হল আন্দোলনে ব্যারিকেড তৈরি করতে করতে।
এসএসসি নিয়ে নিয়োগ-দুর্নীতির অভিযোগে অন্য চাকরিপ্রার্থীদের মতো পথে নেমেছিলেন দু’জন। পরিচয় রাস্তায়। চাকরি-দুর্নীতির বিরুদ্ধে একসঙ্গে আওয়াজ তুলে। পথেই আলাপ। সেই পথই তাঁদের বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থিতে। আলাপ গড়িয়ে গেল প্রেমে। সেই প্রেমের পরিণতিতে গত অগস্ট মাসে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন মিঠুন-খুকুমণি। বিপ্লবের মঞ্চই এক করে দিয়েছে তাঁদের চারহাত।
শুক্রবার এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের লাগাতার আন্দোলন ৬০০ দিনে পা রেখেছে। সূত্রপাত হয়েছিল ২০২০ সালে। সেই বছরে মেয়ো রোডে ওই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ন্যায্য চাকরির দাবিতে পথে নেমে আলাপ হয়েছিল মিঠুন-খুকুমণির। ২০২১-এর প্রথম দিকে মেয়ো রোড থেকে সেই আন্দোলন জায়গা বদলে পৌঁছয় সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কের ৫ নম্বর গেটের অস্থায়ী মঞ্চে। সেই মঞ্চে সুখ-দুঃখ, পরিবার এবং সেই সময়ে সর্বক্ষণের সঙ্গী লড়াই-আন্দোলন নিয়ে কথা বলতে বলতেই একে অপরকে ভাল লেগে যায় তাঁদের। ভাল লাগা থেকে প্রেম। সেন্ট্রাল পার্কের ৫ নম্বর গেটের আন্দোলন ক্রমে মেয়ো রোডের প্রান্তে গান্ধীমূর্তির পাদদেশে পৌঁছয়। কিন্তু মিঠুন-খুকুমণি পরস্পরের হাত ধরে থাকেন।
সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করার। সেই ইচ্ছে মেনে নেন দু’জনের পরিজনেরা। মেনে নেন দুই পরিবারও। চলতি বছরের অগস্ট মাসে দুই বাড়ির অনুমতি নিয়ে বিয়ে করেন মিঠুন-খুকুমণি। তবে বিয়ে করলেও সংসার নিয়ে মেতে নেই দম্পতি। সেই সময় নেই তাঁদের। নেই সেই পরিস্থিতিও। এখনও নিয়ম করে চলছে ধর্না-আন্দোলন-মিছিল-স্লোগান। তাতে যোগ দিচ্ছেন নবদম্পতি।
চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তার মাঝে কেন যৌথজীবন শুরু সিদ্ধান্ত নিলেন মিঠুন-খুকুমণি? আনন্দবাজার অনলাইনকে মিঠুন জানিয়েছেন, প্রেম শুরুর পর থেকে তাঁদের উপর দিয়ে কম ঝড়ঝাপটা যায়নি। দু’জনেই বেকার। ছিল প্রাইভেট টিউশনি করে কিছু রোজগার। সেই টাকাই হাতখরচ হিসেবে ব্যবহার করতেন তাঁরা। দীর্ঘ দিন রাস্তাঘাটে থাকার কারণে সেই টিউশনিগুলিও চলে গিয়েছে। কিন্তু শত দুঃখকষ্টেও একে অপরের হাত ছাড়েননি তাঁরা। কী ভাবে এক সঙ্গে থাকা যায়, তা নিয়ে বিভিন্ন চিন্তা তাঁদের মাথায় বিভিন্ন সময়ে ঘুরপাক খেয়েছে। উদ্বেগ হয়েছে। দুশ্চিন্তা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেন তাঁরা। ভালবাসা তো ছিলই। পাশাপাশিই ছিল জীবনে জীবন জুড়ে লড়াই করার ইচ্ছা। তাঁদের সেই লড়াইয়ে দু’জনের পরিবারই সমান সাহায্য করে চলেছে বলেও মিঠুন জানিয়েছেন।
মিঠুনের কথায়, ‘‘একটা সময়ে জীবনে হতাশা চলে এসেছিল। মনে হচ্ছিল দু’জনেই শিক্ষিত, দু’জনেরই চাকরি পাওয়ার কথা। কিন্তু শুধু মাত্র দুর্নীতির কারণে আমাদের সেই চাকরি তখন হয়নি। চাকরি এখনও হয়নি। কিন্তু খুকুমণি এবং আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে, চাকরি এক দিন আমাদের হবেই! এখন জীবনে সংগ্রাম হলেও বিশ্বাস আছে যে, চাকরি পাওয়ার পর ভবিষ্যৎ জীবনটা উজ্জ্বল হবে।’’
নিয়োগ-দুর্নীতির কথা বলতে গিয়ে মিঠুন বলছেন, ‘‘২০১৯ সালে এসএসসি-র নিয়োগ নিয়ে যে দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসে, ২০২১-এর মধ্যে সেই দুর্নীতির প্রচুর প্রমাণও সামনে এসেছে। এখন তো আদালতও বলছে, আন্দোলনকারীদের দাবি ন্যায্য। তাই আমাদের মনে হয়, আমরা ঠিক এক দিন এই চাকরি পাব। পাবই!’’
চাকরির দাবিতে আন্দোলন এখন মিঠুন-খুকুমণির নিত্যদিনের সঙ্গী। দিনের শুরু থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিদিনের সংগ্রাম। শিক্ষিত হয়েও চাকরি না থাকার কারণে সংসার চলে পৈতৃক সম্পত্তিতে চাষবাস করে। সামান্য কিছু টিউশনি আবার যোগাড় হয়েছে। সেখানে এখন পড়ান তাঁরা। মিঠুন জানান, প্রতি সপ্তাহের শুরুর দিকে দু’-তিন দিন তাঁরা নদিয়ার বাড়িতে থাকেন। সেখানে টিউশনি-চাষবাস সামলে কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় সস্তায় একটি ভাড়াবাড়ি নিয়েছেন। সেখানে থেকে রোজ নিয়ম করে বেরিয়ে যান নিয়োগ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামিল হতে। কখনও আবার দু’জনে দু’জায়গায় থেকে আন্দোলনে যোগ দেন। কেউ অন্য কোনও মিছিলে গেলে অন্য জন ঠিক পৌঁছে যান গান্ধীমূর্তির পাদদেশে।
যেমন শনিবার। বেলা ১২টা নাগাদ গান্ধীমূর্তির পাদদেশে পৌঁছে গিয়েছেন মিঠুন। কিন্তু খুকুমণি তখন তাঁর সঙ্গে নেই। আনন্দবাজার অনলাইন কথা বলতে চেয়েছিল খুকুমণির সঙ্গে। মিঠুন হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের কাছে আমাদের একটা মিছিল আছে। ও ওখানটাই এখন সামলাচ্ছে। ফোন করে দেখতে পারেন। তবে মনে হয় পাবেন না।’’
খুকমণিকে সত্যিই ফোনে পাওয়া গেল না। তবে তিনিও ছিলেন। মিঠুনের সঙ্গে বিশ্বাসের বন্ধনহীন গ্রন্থিতে বাঁধা হয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy