ফ্লাওয়ার সিলিম্যান
অগস্টের সেই অলৌকিক মধ্যরাতে আমি কলেজের ছুটিতে কলকাতায়। টোটি লেনের বাড়িটায় রেডিয়োয় আমার প্রিয় নেতা জওহরলাল নেহরুর কণ্ঠস্বর বেজে উঠল। দুর্দান্ত ‘আপলিফ্টিং’ ছিল সেই বক্তৃতা। মনে আছে, পাড়ার ইহুদি আত্মীয়, বন্ধুরা মিলে প্রথম স্বাধীনতা দিবসে ঘোড়া-গাড়িতে ঘুরেছিলাম! চৌরঙ্গি, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, বৌবাজার— সে কী ভিড়!
নিজেদের নতুন দেশের স্বপ্নে মনটা ভরে ছিল। কিন্তু তীব্র অশান্তি, খুনোখুনির মধ্যে ১৯৪৬-এর সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে লেডি আরউইন কলেজে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এই দেশ ব্যাপারটাই আমার মাথায় ঢোকেনি। ভারতবর্ষ আসলে কী, তা আমাদের চৌরঙ্গি, রূপসী, মেট্রো সিনেমা, জুয়িশ গার্লস স্কুলের জগৎটুকুতে বোঝা সহজ ছিল না। আমার কৈশোর মানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, জাপানি বোমার ভয়, কলকাতার গরিবদের খিদেয় মৃত্যু, ধর্মে ধর্মে ঝামেলা। কিন্তু আমার মতো ইহুদি-বাড়ির মেয়ের কাছে তা যেন কাছে থেকেও দূর থেকে দেখা। দিল্লিতে লেডি আরউইন কলেজে হোমসায়েন্স পড়তে গিয়ে টের পাই, আমার পরিবারের সুরক্ষিত কোটরবন্দি পৃথিবীটার বাইরেও এক মস্ত জগৎ। সেই আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট! ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ও বলতে পারেন।
গান্ধীজি, নেহরু, সর্দার পটেল, কংগ্রেসের বড় নেতারা আমাদের কলেজে নিয়মিত আসতেন! আমিও তখন অন্য মেয়েদের সঙ্গে খুব সে ‘ব্রিটিশ কুইট ইন্ডিয়া’ বলে চেঁচাচ্ছি। পশ্চিমি পোশাক ছেড়ে সেই প্রথম সালোয়ার কামিজ, শাড়ি ধরা। আমি রাতারাতি ভারতীয় হয়ে উঠলাম। আমি কলেজের হেডগার্ল ছিলাম। ইহুদি মেয়ে হয়েও কলেজের উদার পরিবেশে হিব্রুতে প্রার্থনাসভা পরিচালনা করেছি। ভারতবর্ষ আমায় বরাবরই বুকে টেনে নিয়েছে।
মধ্য জীবনে বেশ কয়েক বার এ দেশটা ছাড়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ইজ়রায়েল, ইংলন্ড, আমেরিকায় থেকেছি। কিন্তু কোথাওই ভারতবর্ষ আমার হাত ছাড়েনি। তাই শেষ জীবনে মেয়ে ইয়ায়েলের সঙ্গে গুটিগুটি ময়রা স্ট্রিটে আমাদের আরামের ফ্ল্যাট বাড়িটায় ফিরতে হল।
দিল্লির ছোট্ট কলেজ জীবনই আসলে আমার সারা জীবনের ভিত গড়ে দিয়েছে। স্বাধীনতার আনন্দে নাচতে নাচতে কলেজে ফিরেই দেখি উদ্বাস্তুদের ঢেউ। আমরা বাস্কেটবল কোর্টে উনুন জ্বেলে সারা রাত রুটি করতাম। সেই রুটি উদ্বাস্তুরা খেতেন। নানা হুমকির মধ্যেও আমাদের সহপাঠী হায়দরাবাদের নিজামের বাড়ির মেয়েদের আমরা কলেজে লুকিয়ে রাখি। দিল্লির স্টেশনে ট্রেনের রক্তাক্ত কামরার ছবি চোখে ভাসে, আর গান্ধীজির মৃত্যুর পরের দিনগুলো। আমি পাঁচ টাকা দিয়ে ওঁর অটোগ্রাফ নিয়েছি। ওঁর সামনে ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’ গেয়েছি। গান্ধীর মৃত্যুর পরে নাগাড়ে কতগুলো দিন আমরা দিল্লিময় শান্তির জন্য গাইতাম। এখনও কোরাসে এ গান শুনলে মনে হয়, এ তো আমাদেরই গলা! ইজরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়োর বাড়ি দেখতে গিয়ে দেখি, ঘরে শুধু গান্ধীর ছবি। আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল!
আর প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে এক ঝলক দেখতে আমরা কলেজের মেয়েরা দল বেঁধে রাতে ত্রিমূর্তি ভবনের কাছে যেতাম। দূর থেকে ওঁর আবছা অবয়বটুকু তখন দেখেছি। টেবিলে বসে কাজ করছেন! বড্ড আশ্বস্ত লাগত, মাথার উপরে এমন একজন প্রধানমন্ত্রী আছেন! এ দেশের ইহুদিদের মধ্যে স্বাধীন ভারত নিয়ে আশঙ্কা ছিল। নিজের ধর্ম, সংস্কৃতি রাখা যাবে তো! সবাইকে কি হিন্দি বলতে হবে? আমায় সে-সব ছুঁতে পারেনি। কলেজের দিনগুলো, নতুন ভারতের সংবিধানে ভরসা পেয়েছিলাম। আজকের ভারতে মনে হয়, আমাদের কলেজের মেয়েদের মতো সবাই কি ‘এক মন, এক প্রাণ’? নানা স্বার্থ ঢুকে পড়েছে। তবু, ভারতবর্ষ অনেকটাই পেরেছে। এত গরিব, নিরক্ষরের ভার নিয়ে লড়াই তো করছে।
ইহুদিরা অনেকেই শেষ জীবনটা ইজ়রায়েলে কাটাতে যান। আমার মা, বাবা, স্বামীও গিয়েছিলেন। আমি ইজরায়েলে ভারতীয় রেস্তরাঁ চালাতাম। শেষে বরের কেনা কলকাতার ফ্ল্যাটে ফিরলাম। আমাদের যা সঙ্গতি, বুড়ো বয়সে এত যত্ন আর কোথায় পেতাম! এটাই বাড়ি। এই ৯২ বছরেও আমার স্মৃতি ঝরঝরে। এটা সুখের, আবার কষ্টেরও। এ শহরের মাটির নীচে আমার ঠাকুরমা, দিদিমারা শুয়ে! এক দিন আমিও তাঁদের কাছেই থাকব।
অনুলিখন: ঋজু বসু
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy