প্রতীকী চিত্র
কৃষি সংক্রান্ত যে দু’টি বিল বিজেপি সরকার এনেছে, এক কথায় তা কৃষি অর্থনীতিতে ক্যানসারের মতো। শিল্পক্ষেত্রে মন্দা ক্রমশ ভয়ঙ্কর চেহারা নিচ্ছে। এই সময়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলির শ্যেনদৃষ্টি পড়েছে কৃষি-নির্ভর অর্থনীতিতে। স্বাধীনতা অর্জনের পরে কৃষি-অর্থনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন এনেছিল কংগ্রেস। প্রথমত, জমিদারদের হাত থেকে জমি এসেছিল কৃষকের হাতে। দ্বিতীয়ত, কী ফসল ফলাবেন এবং কতটা ফলাবেন, তা ঠিক করতেন কৃষক। এসেছিল আরও একটি পরিবর্তন। যার ফলে কৃষক তাঁর উৎপাদিত ফসল নিজেই বাজারে বিক্রি করেন। এই দুই পরিবর্তনের ফলে দেশে গ্রামীণ অর্থনীতিতে যতটুকু সাফল্য এসেছে, তা নষ্ট হবে কেন্দ্রের বর্তমান পদক্ষেপে। ওই দুই বিল আইনে পরিণত হলে তার কুপ্রভাব সুদূরপ্রসারী। কৃষকদের জমি থেকে উৎখাত করার যাবতীয় পরিকল্পনা নিহিত রয়েছে দুই বিলে। কেন বলছি এই কথা?
কী ফসল ফলাবেন এবং কতটা ফলাবেন, তা এখন নির্ভর করে কৃষকের উপরে। তিনি এ ক্ষেত্রে স্বাধীন। কিন্তু এই বিলে কৃষকের সেই স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার সমস্ত সুযোগ রয়েছে। বিল আইনে পরিণত হলে, কর্পোরেট সংস্থার নির্দেশে ফসল ফলাতে হবে চাষিকে। নিজের জমিতে ‘দাস’-এ পরিণত হবেন চাষি। এক সময়ে হুগলি ও মুর্শিদাবাদে অনেক বেশি পাট চাষ হত। এখন অতটা হয় না। চাষিরা অন্য ফসল ফলাচ্ছেন। তাতে তাঁদের লাভ বেশি হচ্ছে। স্বাধীন ভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চাষিরা। কিন্তু যে দু’টি বিল আনা হয়েছে, তাতে চাষিদের হাতে আর সেই স্বাধীনতা থাকবে না। কর্পোরেট সংস্থা যদি চায়, হুগলি ও বর্ধমানে আলুর পরিবর্তে চাষি খাদ্যশস্য বেশি উৎপাদন করুন, চাষিদেরর সেটাই করতে হবে। কারণ, গোটা উৎপাদন ব্যবস্থাটাই তত দিনে বাজারমুখী করে তুলবে কর্পোরেট সংস্থাগুলি। বর্ধমানকে রাজ্যের ‘ধানের গোলা’ বলা হয়। একবার উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ কর্পোরেট সংস্থার হাতে চলে গেলে তাঁদের ইচ্ছায় সেখানে ধানের উৎপাদন না-ও হতে পারে। সিঙ্গুরে বহুফসলি জমিতে বছরে চার বার চাষ হয়। অতি-উৎপাদনজনিত সঙ্কটে পড়লে কর্পোরেট সংস্থা সেখানে একটি বা দু’টি চাষ করতে বলতে পারে চাষিদের। তখন বিপদে পড়বেন তাঁরা।
ফসলের দামের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আস্তে আস্তে চলে যাবে কর্পোরেট সংস্থাগুলির হাতে। কৃষক ‘ন্যূনতম সহায়ক মূল্য’ পাবেন বলে কেন্দ্রের তরফে জোর দিয়ে বলা হচ্ছে। আমার প্রশ্ন, এখনও তো ‘ন্যূনতম সহায়ক মূল্য’ দেওয়া হয় বলে সরকার দাবি করে। কিন্তু কৃষকেরা আদৌ কি তা পান? বাস্তব বলছে, তাঁরা সেই দাম পান না। নতুন ব্যবস্থা যে কত ভাল, সেটা বোঝাতে প্রথম দিকে চাষিদের থেকে অনেক টাকা দিয়ে ফসল কিনবে কর্পোরেট সংস্থা। তারপর ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করবে ওরা। শর্তাধীন করে তুলবে চাষিদের। তারপর উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন— গোটা ব্যবস্থাটাই নিয়ন্ত্রণ করবে কর্পোরেট।
কৃষি বিলের আরও ভয়ঙ্কর কয়েকটি দিক রয়েছে। জমিতে ফসল কতটা ফসল ফলানো যেতে পারে, তা বোঝেন শুধু চাষি। জমির উর্বরতা শক্তি ধরে রাখতে কোন সার কতটা দিতে হবে, তা তাঁরাই বোঝেন। কিন্তু নয়া ব্যবস্থায় বাজারের চহিদা মোতাবেক ফসল ফলাতে হবে জমিতে। ফলে জমির উর্বরতাশক্তি হারিয়ে যাবে। বন্ধ্যা হবে জমি। ফসলের গুণমান কমবে। সেই জমি বাধ্য হয়ে অল্প দামে কর্পোরেট সংস্থাকে দিয়ে দিতে হবে কৃষকদের। না-থাকবে জমি, না-থাকবে পয়সা। কৃষকদের আত্মহত্যা বাড়বে।
দুই কৃষিবিলের বিরুদ্ধে যে লড়াই শুরু হয়েছে, তাতে কৃষকদের যোগ দিতে হবে। তাঁদের ওই দুই বিলের ক্ষতিকারক দিকগুলি বুঝতে হবে। বোঝাতে হবে তাঁদের। এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে কৃষকদের।
(মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy