Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Cattle Trafficking

বদলেছে কারবার, থেকে গিয়েছেন কর্তা

পার হয়ে যায় গরু। অনায়াসে। বছরের পর বছর। এখন? পাচার বন্ধ হতে সরকারি প্রকল্পে মাটি কোপানোর ‘কম পয়সার কাজ’ এদের অনেকেরই পোযায়নি। অনেকে চলে যায় ভিন্ রাজ্যে বা বিদেশে— কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ বা হোটেলের কাজ নিয়ে।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২০ ০৪:১৫
Share: Save:

আপাতত কিছু নেই, অন্তত চোখে পড়ার মতো। কিন্তু ক’বছর আগের রাতগুলো এখনও এলাকার স্মৃতিতে জীবন্ত। বর্ডার রোডের পাশে বাগদার বিল, গড়ার বিল, প্রতাপতলার বিল বা জলঙ্গিতলার বিলে মানুষ সমান উঁচু পাটখেতের আড়ালে জড়ো হচ্ছে গরু। আশপাশে নিঃশব্দ ছায়ামূর্তি।

কাঁটাতারের ওপারে বাংলাদেশের দিকে তুমুল ব্যস্ততা। কয়েক জন এক-এক করে তার কেটে কাঁটাতারের মধ্যে দিয়ে সুড়ঙ্গ বানিয়ে ফেলছে। তার পর ফোন এলেই ছায়ামূর্তিরা গরুদের পা ভাঁজ করিয়ে ঠেলে দিচ্ছে কাঁটাতারের সুড়ঙ্গ দিয়ে। আর ও পার থেকে তাদের গলা ধরে টেনে নেওয়া হচ্ছে। আধ ঘন্টায় শ’দুয়েক গরু হাওয়া! দূর থেকে বিএসএফের সাড়াশব্দ আসার আগেই আলো নিভিয়ে গাঢ় ঘুমে হাটখোলা, মহখোলা, রাঙ্গিয়ারপোতা, পদ্মপালা, ফুলকলমি বা এলাঙ্গির মতো সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামগুলো।

২০১৫ সাল পর্যন্তও নদিয়া সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়েছে হাজার হাজার গরু। মুর্শিদাবাদ বা উত্তর ২৪ পরগনার মতো বড় কারবার না হলেও পাচারের অন্যতম ‘রুট’ ছিল এই স্থলপথ। বর্ধমান থেকে নবদ্বীপের গৌরাঙ্গ সেতু পেরিয়ে গরুর লরি যেত কৃষ্ণনগরের কাছে ঝিটকেপোতায়। সেখান থেকে ছোট ছোট ‘পেপসি’ গাড়িতে দোগাছি, হাঁসখালি হয়ে বগুলা-দত্তফুলিয়া। তার পর বনগাঁ অথবা হাবাসপুর। গরু আসত বিহার থেকেও, কৃষ্ণনগরের গোহাটে নামত। ছোট গাড়িতে চলে যেত হাঁসখালি, কৃষ্ণগঞ্জ, চাপড়ায়।

আরও পড়ুন: উৎসবের মরসুমে রেশন দোকানে মিলবে সর্ষের তেল​

হুগলির পাণ্ডুয়ায় গরুর হাট থেকে লরি এসে ঈশ্বর গুপ্ত সেতু পেরিয়ে কল্যাণীর ভিতর দিয়ে চলে যেত ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে। হরিণঘাটায় বিরহীর গরুর হাট থেকেও গরুর লরি ছড়িয়ে পড়ত জেলার বিভিন্ন প্রান্তে। অথবা চাকদহ চৌমাথা থেকে বনগাঁ বর্ডারের রাস্তা ধরত।

আরও পড়ুন: করোনা পরীক্ষার খরচ নিয়ে ​

উত্তরে তো করিমপুর, থানারপাড়া, মুরুটিয়া, হোগলবেড়িয়া ছিল কার্যত মুক্তাঞ্চল। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা থেকে জলঙ্গি পার হয়ে গরু আসত থানারপাড়ার পণ্ডিতপুর, ফাজিলনগর, পিয়ারপুর বা লক্ষ্মীপুরে। সেখান থেকে পাকসি, ব্রজনাথপুর, বালিয়াডাঙা সীমান্তে। গোপালপুর দিয়ে জলঙ্গি বা ডোমকল থেকেও হোগলবেড়িয়ায় ঢুকত গরু। কিছু গরু বাউশমারি দিয়ে পদ্মা পেরিয়ে চলে যেত বাংলাদেশ। কিছু কাছারিপাড়া, হোগলবেড়িয়া হয়ে সীমান্ত পেরোত। বিশেষ করে চাপড়ার মহখোলা থেকে রাঙ্গিয়ারপোতা বা হুদোপাড়ায় তখন কাঁটাতার না থাকায় ছিল পাচার ছিল প্রায় অবাধ। পুলিশ বা বিএসএফের একাংশের সঙ্গে নাম জড়িয়ে ছিল তদানীন্তন শাসক দলের কিছু নেতারও, পাচারের কারবারে যাঁদের টাকা খাটত।

মুর্শিদাবাদের মতো বড় মাথা কিন্তু নদিয়ার গরু পাচারে কেউ সে ভাবে ছিল না। এক-এক এলাকায় ছোট ছোট দল। যেমন করিমপুরে মহিরুদ্দিন, চাপড়ায় চাঁদু বা ঝিটকেপোতায় হোসেনরা কারবার চালাত বলে জেলা গোয়েন্দা দফতর সূত্রের খবর। বাধা দিলে পাল্টা হামলাও হত। পাচার আটকাতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন এক ডিএসপি। অস্ত্রের কোপে জখম হয়েছিলেন ১১৩ নম্বর ব্যাটেলিয়নের ইন্সপেক্টর চন্দ্রবীর সিংহও।

আরও পড়ুন: শাহদের সঙ্গে চর্চা, ‘চাপা’ রাহুলের ক্ষোভ​

বিএসএফ কড়াকড়ি শুরু করায় ২০১৫ থেকে পাচার প্রায় থিতিয়ে যায়। পাচারের নানা কাজে যুক্ত প্রায় কয়েক হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। লরি থেকে এক জোড়া গরু নামিয়ে সীমান্তের গ্রাম পর্যন্ত নিয়ে গেলে সে কালে এক জন ‘রাখাল’ বা ‘লেবার’ পেত দেড় থেকে দুহাজার টাকা। যারা সীমান্ত পার করে গরু ও পারে পৌঁছে দিত, তাদের পারিশ্রমিক প্রতি জোড়ায় ছয় থেকে দশ হাজার। তাদের ঝুঁকি বিরাট, হিসেবে একটু ভুলচুক হলেই তাদের বুক ফুঁড়ে দিতে পারে বিএসএফের গুলি।

পাচার বন্ধ হতে সরকারি প্রকল্পে মাটি কোপানোর ‘কম পয়সার কাজ’ এদের অনেকেরই পোযায়নি। অনেকে চলে যায় ভিন্ রাজ্যে বা বিদেশে— কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ বা হোটেলের কাজ নিয়ে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, লকডাউনে অনেকেই গাঁয়ে ফিরেছিল। কয়েক মাস বসে থেকে এখন আবার কর্মস্থলে ফিরছে। আর এখানে? চাষের খেত মা়ড়িয়ে গরুর পালের চলা বন্ধ হলেও পাচার কিন্তু বন্ধ হয়নি। যারা ‘মালদার পার্টি’ বলে পরিচিত তারা সোনা, কাশির সিরাপ, এবং ভাঙা পিতল পাচারের কারবার করছে।তবে কারবার পাল্টালেও কিছু নেতা এবং কর্তা অবশ্য থেকেই যাচ্ছেন, যাঁরা সঙ্কেত দেন ‘লাইন ক্লিয়ার!’

অন্য বিষয়গুলি:

Cattle Trafficking Trafficking Cow
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE