ভরাডুবির কারণ নিয়ে নানা মত সিপিএম-এ। ফাইল চিত্র
২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে বাংলায় ২৩৫টি আসনে জিতেছিল সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট। সেই বামফ্রন্টই ২০১১-র বিধানসভা ভোটে নেমে এসেছিল ৬২টি আসনে। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে আরও কমে হয় ৩২। তার পাঁচ বছর পরে তারা শূন্য! অথচ, দেড় দশক আগেও পশ্চিমবঙ্গ দেশে পরিচিত ছিল ‘বামদুর্গ’ হিসেবে!
রাজ্য থেকে বামেদের বিদায়-করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভা নির্বাচনের ফল দেখে বলেছিলেন, ‘‘আমি চাইনি কেউ শূন্য হয়ে যাক! ওরা নিজেদের এতটাই বিজেপি-র দিকে ঠেলে দিয়েছে, যে নিজেরাই সাইনবোর্ড হয়ে গিয়েছে। বিজেপি-র চেয়ে ওরা কিছু থাকলে ভাল হত।’’
মমতা যা বলেননি, বাংলার ভোটকাব্যে সিপিএম উপেক্ষিতা নয়। আসলে সিপিএমের কাব্যটাই উপেক্ষিত। ফলে গায়ক বদল করেও গান হিট করানো যায়নি। ভোটের ভরাডুবির পর্যালোচনায় নেমে একই কথা বলা উচিত ছিল সিপিএমেরও। কিন্তু তা বলতে পারল না।
দলের নেতাদের একটা অংশ মনে করছে, সিপিএম যে যে কারণগুলির দিকে নির্দেশ করতে পারত, তা তারা করেনি। বিধানসভা ভোটে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এ বার বাহ্য কয়েকটি বদল এনেছিল সিপিএম। তার মধ্যে অন্যতম হল প্রার্থী বদল করা। পুরোন মুখ বাতিল করে নতুন এবং তরুণ মুখ আনা হয়েছিল। তরুণ ভোট ব্যাঙ্কের দিকে লক্ষ্য রেখে দীপ্সিতা ধর, ঐশী ঘোষ এবং মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের মতো মুখকে ভোটে টিকিট দিয়েছিল সিপিএম। সকলেরই শোচনীয় হার হয়েছে।
সেই হারের কারণ হিসেবে বিবিধ ব্যাখ্যা রয়েছে। একটি ব্যাখ্যা হল, যাঁদের টিকিট দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা প্রাচীনদের চেয়েও বেশি ‘প্রাচীনপন্থী’। দ্বিতীয়ত, সাধারণ ভাবে সারা পৃথিবীতেই কমিউনিজমের ধ্যানধারণা অতীত। কোথাও কোথাও অস্তিত্ব থেকে গেলেও পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই কমিউনিজমকে খারিজ করেছে। যেমন ভারতেও কেরলে এখনও কমিউনিজম রয়েছে। সেখানকার সরকারও কমিউনিস্টদের দ্বারা শাসিত। কিন্তু তা-ও কতদিন থাকবে, তা নিয়েও তর্ক উঠতে শুরু করেছে।
বাংলার মানুষের কাছে সিপিএম এখনও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কথা বলে। আধিপত্যবাদের কথা বলে। বাংলার আধুনিক প্রজন্ম ভিয়েতনামকে চেনে পর্যটনের গন্তব্য হিসেবে। তারা ভিয়েতনাম যুদ্ধের ইতিহাস সে ভাবে জানেও না। তারা চাকরি চায়, বিভিন্ন অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধা নিয়ে অনেক বেশি মাথা ঘামায়। এই প্রজন্মের বাঙালি অনেক বেশি উৎসাহিত আধুনিক প্রযুক্তি, গ্যাজেট নিয়ে। তারা অনেক বেশি আগ্রহী অ্যামাজন প্রাইম, নেটফ্লিক্সের মতো ওটিটি প্ল্যাটফর্মে নতুন ছবি বা লিওনেল মেসির বার্সেলোনা-ত্যাগ নিয়ে।
বিধানসভা ভোটে সিপিএম লড়তে নেমেছিল দুই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে— তৃণমূল এবং বিজেপি। রাজনীতির যুদ্ধের চিরাচরিত পদ্ধতি হল, কখনও যুদ্ধে পাশাপাশি দুটো ফ্রন্ট খোলা রেখে লড়তে নেই। তাতে চিঁড়েচ্যাপ্টা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। ঠিক যেমন হয়েছে সিপিএমের ক্ষেত্রে। দলের নেতাদের একটি অংশের এমনই অভিমত।
ওই অংশের নেতারা আরও মনে করছেন, বিধানসভার মতো স্থানীয় ভোট স্থানীয় প্রশ্নেই লড়া উচিত। জাতীয় বিষয়ে নয়। কিন্তু সিপিএম বিধানসভার সঙ্গে লোকসভার ভোট গুলিয়ে ফেলেছিল। ওই নেতারা অবশ্য পাশাপাশিই জানাচ্ছেন, দলের অন্দরে কোথাও কোথাও আলোচিত হলেও কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে এই পর্যবেক্ষণে আসা সম্ভব ছিল না। তাঁদের মতে, ‘‘এগুলো বললে তো নিজেদের উপর আলো ফেলতে হয়! সেই স্বীকারোক্তি করতে পারলে তো এই অবস্থা হয় না!’’
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি ভোটে বিপর্যয়ের কারণ একই সঙ্গে বিজেপি-র বিরোধিতা এবং তৃণমূলের ১০ বছরের শাসনকালের ত্রুটি তুলে ধরার কথা বলেছে। কিন্তু পাশাপাশিই তারা বলেছে, এতদ্সত্ত্বেও বাংলার মানুষ সংযুক্ত মোর্চাকে ‘বিকল্প’ হিসেবে মনে করেনি।
পাশাপাশিই রয়েছে আপাত-দুর্বোধ্য ভাষা এবং প্রাচীন শব্দপ্রয়োগের প্রবণতা। দলের এক নেতার কথায়, ‘‘এটা ঠিকই যে, আমাদের শব্দচয়ন এবং শব্দপ্রয়োগে সমস্যা আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে সহজ ভাষায় ছড়া কেটে-কেটে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন, সেটা আমরা এখনও রপ্ত করে উঠতে পারিনি।’’ দলের নেতাদের একটা অংশ মনে করছে, সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায় সিপিএমের বামপন্থা এখন ‘সেকেলে’ হয়ে গিয়েছে। গায়কদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, ‘জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব’ নামক গানটাই জনপ্রিয়তা হারিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy