Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
অনুব্রত মণ্ডল জেলে। ভোটের আবহ কেমন সন্ত্রাস-ক্লান্ত বীরভূমে?
West Bengal Panchayat Election 2023

‘ওদের মারো’! বিদ্বেষের বিষবৃক্ষ বাড়ছে গ্রামে

গ্রামে ঢোকার মুখে তিন তলা প্রাসাদোপম বাড়ির বাসিন্দাদের হাবেভাবেও একই জেদ। দু’পক্ষেরই বহু সদস্য খুন আর পাল্টা খুনের ঘটনায় জেল খাটছে। তার পরেও গ্রাম জুড়ে যেন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।

bogtui.

বগটুই গ্রামে সোনা শেখের বাড়ির দেওয়ালে রক্তের দাগ (বাঁ দিকে)। এখান থেকেই উদ্ধার হয়েছিল সাতটি দগ্ধ দেহ। সেই ঘটনায় মা, স্ত্রী ও কিশোরী মেয়েকে হারানো মিহিলাল শেখ দাঁড়িয়ে জানলায়। —নিজস্ব চিত্র।

সোমা মুখোপাধ্যায়
বগটুই (রামপুরহাট) শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০২৩ ০৭:২৮
Share: Save:

দেওয়াল জুড়ে রক্তের ছোপ। শুকিয়ে কালচে, কিন্তু ফিকে নয়। পোড়া মেঝে, পোড়া সিলিং। চতুর্দিকে ছড়ানো ভাঙা জানলার কাচ। টেবিলে কোনও এক সময়ে যত্নে সাজানো চায়ের কাপ-প্লেট-পটে পুরু ঝুল। দীর্ঘ দিন গৃহস্থের বাস চুকে যাওয়া ঘরে বোলতার চাক। সামান্য অসাবধানতায় যার হুল বিদ্ধ করতে পারে আগন্তুককে।

ঠিক এর আগেই বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে যাঁদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, দেওয়ালের ওই রক্ত তাঁদের কারও স্ত্রী, কারও মা, কারও কিশোরী কন্যার। কিন্তু ওই মুহূর্তে অন্তত কারও স্বরে সেই বেদনার ছিটেফোঁটা নেই। যা আছে, তা শুধুই ঘৃণা আর আক্রোশ। বদলার অপেক্ষায় চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে।

গ্রামে ঢোকার মুখে তিন তলা প্রাসাদোপম বাড়ির বাসিন্দাদের হাবেভাবেও একই জেদ। দু’পক্ষেরই বহু সদস্য খুন আর পাল্টা খুনের ঘটনায় জেল খাটছে। তার পরেও গ্রাম জুড়ে যেন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। বীভৎস হত্যালীলার ১৫ মাস পরেও বগটুই গ্রামে টানটান, যুযুধান দুই পক্ষের ছবি বীরভূমে তৃণমূলের ‘মুষল পর্ব’কেই বার বার বেআব্রু করে দিচ্ছে বলে মনে করছেন দলের নেতাদের একাংশ। তাঁদের মতে, পঞ্চায়েত ভোটের আগে ভিতরে ভিতরে তেতে থাকা বগটুইয়ের মানুষের এখন স্রেফ দু’টো ভাগ। বর্তমান তৃণমূলী আর প্রাক্তন তৃণমূলী।

গত বছর ২১ মার্চ ১৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে দুষ্কৃতীদের ছোড়া বোমার আঘাতে খুন হন রামপুরহাটের বড়শাল পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ভাদু শেখ। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শুরু হয় ব্যাপক বোমাবাজি। ভাদুবিরোধী একাধিক বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পুড়িয়ে-কুপিয়ে খুন করা হয় মোট ১০ জনকে। তাদের মধ্যে শুধু ভাদুবিরোধী বলে পরিচিত সোনা শেখের বাড়ি থেকেই উদ্ধার হয় পুড়ে খাক সাতটি দেহ। তাঁদের মধ্যে এক কিশোরী, পাঁচ মহিলা, এক যুবক। চলতি বছরের মার্চে এই ঘটনার এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দলের কিছু কর্মী-সমর্থক বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। বছরপূর্তির স্মরণসভায় ওই এলাকায় মাত্র কয়েক ফুটের ব্যবধানে তৃণমূল ও বিজেপির দু’-দু’টো ‘শহিদ-বেদি’ও তৈরি হয়েছে। টক্কর দেওয়ার চেষ্টা?

বীরভূমে বিজেপির সাংগঠনিক জেলার কর্তারা বলছিলেন, ‘‘টক্কর তো হবেই। শুধু বগটুই নয়, একাধিক জায়গাতেই তৃণমূলের নিজেদের খেয়োখেয়ির বলি হয়েছেন বহু মানুষ। বিরোধীদের দরকার নেই। দলের ভিতরের লোকেরাই এখন পরস্পরের শত্রু। পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফলে তার খানিকটা প্রভাব পড়তে বাধ্য।’’ একই সুর সিপিএম, কংগ্রেসেও। কিছু মাস আগেও যাঁদের স্বর প্রায় শোনাই যেত না, তাঁরাও এখন টক্করের গল্প বলছেন। বলছেন, ‘‘অনুব্রত মণ্ডল জেলে যাওয়ার পরে এই জেলায় এমনিই তো এদের দিশাহারা অবস্থা। এর পরে আরও কারা জেলে ঢুকবে, সেই ভয়েই সকলে তটস্থ।’’

মন্ত্রী তথা জেলায় তৃণমূলের কোর কমিটির সদস্য চন্দ্রনাথ সিংহের দাবি, ‘‘রামপুরহাট, ময়ূরেশ্বর, মহম্মদবাজার, খয়রাশোলের মতো কয়েকটা জায়গায় একটু সমস্যা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ওগুলো সামলে নেওয়া যাবে।’’ নেতার কান বাঁচিয়ে দলের এক প্রবীণ কর্মী অবশ্য এর কিছু পরেই শুনিয়ে গেলেন, ‘‘জেলা সভাপতি জেল খাটছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে মুঠো সামান্য হলেও আলগা হবে না, তা কি হয়? বড়সড় নয় ঠিকই, কিন্তু গলায় কিছু কাঁটা তো বিঁধছেই।’’

বগটুই পৌঁছলে সেই সব ‘কাঁটা’ আর আলাদা করে খুঁজতে হয় না। বৃদ্ধ বানিরুল শেখের পুত্রবধূ সীমা তাঁর দেড় বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে বলছিলেন, ‘‘এই যে, শুধু এর জন্য আমি, আমার স্বামী, আর আমার বড় ছেলে বেঁচে গেছি। না হলে ওই দেওয়ালে আমাদেরও রক্ত থাকত।’’ সন্তান হওয়ার জন্য বাবা-মায়ের বাড়িতে ছিলেন সীমারা। যে রাতে ওই ঘটনা ঘটে, সে দিন সকালেই তাঁর শাশুড়ি, ননদ ও নন্দাই বাচ্চা দেখতে সেখানে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় তাঁরা ফিরে আসেন। সীমার সঙ্গে সেই তাঁদের শেষ দেখা। সীমার শ্বশুর বানিরুল এবং কাকাশ্বশুর মিহিলাল কোনওমতে পালিয়ে বাঁচলেও বাকিরা পারেননি। মিহিলালের মা, স্ত্রী, ন’বছরের কিশোরী কন্যা, সকলকেই জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল সেই রাতে। সেই সীমাই এ বার বিজেপির হয়ে পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী হয়েছেন। ভোট-প্রচারের ব্যস্ত সময়ে ভরদুপুরে ঘর মুছছেন দেখে প্রশ্ন করলাম, প্রচারে যাচ্ছেন না? ‘‘দু’টো বাচ্চা আর ঘরদোর সামলে প্রচারে বেরোনোর সময় আছে বলে মনে হয়?’’ পাল্টা প্রশ্ন করেন তিনি। তা হলে ভোটে দাঁড়ালেন কেন? সীমা জবাব দেন, ‘‘যারা আমাদের সর্বনাশ করেছে, তাদের জাহান্নমে পাঠানোর জন্য আর এই বাচ্চাগুলোকে বাঁচানোর জন্য আমাকে প্রার্থী করেছে আমার পরিবার। বাকি প্রশ্ন আমার স্বামীকে করুন। বলতে পারবে।’’ তাঁর স্বামী অর্থাৎ বানিরুলের ছেলে কিরণ বলেন, ‘‘নিরাপত্তার জন্য ভোটে লড়া দরকার। তৃণমূলকে এক ফোঁটা বিশ্বাস করি না।’’ সেই নিরাপত্তা বিজেপিতে যোগ দিলে পাবেন, সেটা নিশ্চিত? কিরণের জবাব, ‘‘বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম, আমাদের কাছে আর দলটা বিষয় নয়। তৃণমূলের বিরোধী হলেই হল।’’

ওই গ্রামেরই ফটিক শেখ হাঁফাতে হাঁফাতে এসে প্রায় জোর করেই নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়ি। বাড়ির দাওয়ায় রক্তের দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘‘হাজার বার ধুয়েও এই দাগ যায়নি। এখানেই বসেছিল আমার স্ত্রী। বোমাবাজি শুরু হতে আমাকে বলল, ‘তুমি ওদের টার্গেট, তুমি পালাও। আমাকে ওরা কিছু করবে না।’ ভুল ভেবেছিল ও। বাড়ির দাওয়াতেই পিটিয়ে, কুপিয়ে ওকে মেরে ফেলে ওরা। বোলপুরে বসে নেতারা সব খবর রাখছিলেন। ওঁরাই করিয়েছেন এটা। আমি নিজে তৃণমূল করতাম। আর এখন শুধু দোওয়া করি, এই দলটা নিশ্চিহ্ন হোক। তাতে যাদের হাত ধরতে হয়, ধরব।’’ মিহিলালও বলছিলেন, ‘‘যারা সে দিন পেট্রল জ্বালিয়ে আমার মা, বউ, মেয়েকে পুড়িয়ে মারল, তাদের সঙ্গে দল করতাম আমি। আমার বাড়িতে রোজ এসে ওরা আমার স্ত্রীকে বলত, ‘ভাবি, চা দাও।’ আমার মেয়েকে জন্ম থেকে কোলে বসিয়ে আদর করেছে ওরা। কিন্তু মারতে হাত কাঁপল না কারও।’’

ভাদুপন্থীদের গলাতেও পাল্টা আক্রোশ। প্রকাশ্যে আসতে চান না কেউই। বহু জোরাজুরির পরে এক জন শুধু বললেন, ‘‘দলে থেকে বেইমানি করলে যা শাস্তি হওয়ার, তা-ই হয়েছে। পঞ্চায়েতে অন্য দলে লড়ে জিতবে ভাবছে, একটা জায়গাতেও জিতবে না ওরা। আমরা আছি, থাকবও।’’

বগটুইয়ের রাস্তায় পায়ে পায়ে এই শত্রুতার গন্ধ। ‘‘দুর্ভাগ্য কী জানেন, আমরা-ওরার সংস্কৃতিকে একেবারে গলা পর্যন্ত আত্মসাৎ করে নিয়েছে আমাদের দল। এখন আর বিরোধীদের হাতে মার খেতে হচ্ছে না। নিজের দলের লোকেদের হাতেই মার খাচ্ছি।’’ বীরভূমের প্রবীণ নেতা ফোনে এই আক্ষেপ করছিলেন, এক সময়ে তিনি নিজে সিপিএমের হাতে মার খেয়েছেন, লুকিয়ে থেকেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘মহাভারতের মুষল পর্বে যাদবরা যে ভাবে নিজেদের মধ্যে হানাহানি, রক্তপাত ঘটিয়েছে, আমাদের দলটার এখন ঠিক সেই অবস্থা। এর শেষ কোথায় কে জানে!’’

মনে পড়ল, সীমা বলেছিলেন ‘শত্রুদের জাহান্নমে পাঠানো’র কথা। সীমার ঘর ছেড়ে বেরোনোর সময়ে কানে এসেছিল প্রতিবেশী এক শিশু বলছে, ‘ওদের মারো। জাহান্নমে পাঠাও।’ কাকে মারবে? পোড়া বাড়ির দিকে তাকিয়ে শিশু আপন মনে বলে চলে, ‘‘ওই যে ওখানে জ্বালিয়ে দিয়েছিল সবাইকে। ওদের মারো।’’

বিদ্বেষের যে বীজ গোটা এলাকায় ছড়িয়ে‌ রয়েছে, তা থেকে রেহাই পায়নি ওই একরত্তির শৈশব। সন্ত্রাসের নিয়ন্ত্রকেরা জেলে থাকতে পারে, কিন্তু সন্ত্রাসের সংস্কৃতি স্বাধীন ভাবেই ঘুরছে সর্বত্র।

(চলবে)

অন্য বিষয়গুলি:

West Bengal Panchayat Election 2023 Birbhum Bogtui
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy