গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
বাঘ কি বশ হল? সিবিআইয়ের হেফাজতে বন্দি সন্দেশখালির ‘বাঘ’ শাহজাহান শেখের কথাবার্তায় গত কয়েক দিনে কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের। সিবিআই সূত্রের খবর, আচমকা জেগে উঠেছে শাহজাহানের ঠিক-ভুলের বিচারবোধ। জেরায় তিনি সিবিআইকে জানিয়েছেন, সন্দেশখালিতে যা হয়েছে, তা একেবারেই ঠিক হয়নি!
গত ৫ জানুয়ারি শাহজাহানভূমেই আক্রান্ত হয়েছিলেন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) আধিকারিকেরা। সন্দেশখালির তৃণমূল নেতা শাহজাহানের বাড়িতে তল্লাশি চালাতে-যাওয়া ইডি কর্তাদের উপর বাঁশের লাঠি, পাথর, আধলা ইট নিয়ে চড়াও হন গ্রামবাসীরা। মার খেয়ে জখম তিন ইডি আধিকারিককে ভর্তি করাতে হয় হাসপাতালেও। যার জেরে বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবিও জানিয়েছিল বিরোধী বিজেপি। সেই ঘটনারই মূল অভিযুক্ত শাহজাহান। ইডি তাদের অভিযোগে জানিয়েছিল, শাহজাহানের নির্দেশেই ওই হামলা চালানো হয়েছিল ইডির আধিকারিকদের উপর। যার ফলে শাহজাহানের পক্ষে ইডির চোখ এড়িয়ে পালানো সহজ হয়েছিল। এমনকি, তাঁদের মতে, ওই হামলার ফলেই বাড়ি থেকে সে দিন সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রও সরিয়ে ফেলেছিলেন শাহজাহান।
সিবিআইয়ের একটি সূত্রের বক্তব্য, সম্প্রতি সেই শাহজাহানই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার জেরায় বলেছেন, সন্দেশখালিতে সে দিন যা হয়েছিল, তা মোটেই ঠিক হয়নি। অর্থাৎ, শাহজাহানের কথায়, ইডির উপর হামলা চালানো উচিত হয়নি সন্দেশখালিতে। তদন্তকারী সংস্থার অবশ্য অনুমান, পরোক্ষে শাহজাহান বলতে চাইছেন, তিনি নিজে ওই হামলা করাননি। যারা করিয়েছে বা করেছে তিনি তাদের সমর্থনও করেন না। সেই কারণেই সিবিআই ওই বক্তব্য মানতে নারাজ। তাদের মতে, সন্দেশখালির ‘বাঘ’ এখন ‘ভাল ছেলে’ সেজে মাথা নোয়ালেও তাঁর অজান্তে সন্দেশখালিতে কিছু হবে, সেটা সম্ভব নয়। সেটা সিবিআইয়ের তদন্তকারী এবং প্রশ্নকর্তারা মেনেও নিচ্ছেন না। তাঁদের বক্তব্য, শাহজাহান এখন পুরো বিষয়টি থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে চাইছেন। কিন্তু তাঁর সন্দেশখালি-সহ লাগোয়া কিছু এলাকায় যা ‘প্রভাব’ এবং ‘প্রতিপত্তি’ ছিল, তাতে তাঁর অগোচরে বা বিনা নির্দেশে সব হয়ে গিয়েছে, এমন হতে পারে না।
শাহজাহান সন্দেশখালিতে কতখানি ‘প্রভাবশালী’ তা দেখেছে এবং জেনেছে সিবিআই। সে ভাবে কোনও প্রশাসনিক পদে না থেকেও রাজ্যের মন্ত্রীদের একাংশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তাঁর। শুক্রবারেই তাঁর একাধিক গাড়ির হদিস পেয়েছেন তদন্তকারীরা। সেগুলি বাজেয়াপ্তও করা হয়েছে। সন্দেশখালিতে শাহজাহানের নামে ফ্যান ক্লাব, তাঁর নামে আস্ত বাজার, তাঁর জন্য হাজারখানেক গ্রামবাসীর অস্ত্র হাতে একত্র হওয়া— এ সবই শাহজাহানের ‘প্রতিপত্তি’র অকাট্য প্রমাণ বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। গ্রামে কার কত সম্পত্তি, সেটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রভাবের সূচক। সে দিক দিয়ে সন্দেশখালির মতো এলাকায় শাহজাহানের চলনবলন, আদবকায়দা— সবই তাঁর প্রভাবেরই বর্ণনা দেয়। সেই সূত্রেই তদন্তকারীদের যুক্তি, এ হেন শাহজাহানের বাড়ির সামনে ইডির উপর হামলা হবে আর তা আগে থেকে তাঁর কানে উঠবে না, সেই বিষয়টিই অবাস্তব!
সিবিআই সূত্রের আরও বক্তব্য, যদি শাহজাহানের এখনকার বক্তব্য ঠিকও হয়, অর্থাৎ তিনি যদি ওই হামলা না-ও করিয়ে থাকেন, তা হলে তিনি ইডির ডাকে সাড়া দেননি কেন? পরেই বা ইডির সঙ্গে যোগাযোগ করেননি? কেন ৫৬ দিন ধরে তাঁকে পালিয়ে বেড়াতে হল? নির্দোষ হলে কেন তাঁকে নিখোঁজ হয়ে থাকতে হল?
সেই সূত্রেই সিবিআই গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, ধরা পড়ে দোষ অস্বীকার করাই অপরাধীর স্বাভাবিত প্রবণতা। শাহজাহানও সেটাই করছেন। অর্থাৎ ‘বাঘ’ আদৌ বশ্যতা স্বীকার করেননি। তিনি স্রেফ নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। সেই একই নীতিতে শাহজাহান নিজের দোষ অন্যদের ঘাড়েও ঠেলছেন বলে মনে করছে সিবিআই। সূত্রের খবর, জেরায় শাহজাহান ইঙ্গিত দিয়েছেন, কারা ওই হামলা করিয়ে থাকতে পারেন। এর মধ্যে জিয়াউদ্দিন মোল্লার নামও উঠে এসেছে। যিনি শাহজাহানের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলেই সন্দেশখালিতে পরিচিত এবং শাহজাহানের গ্রেফতারির তিন দিনের মধ্যেই গ্রেফতারও হয়েছেন। উল্লেখ্য, এই জিয়াউদ্দিন শাহজাহানের গ্রাম সরবেড়িয়ার পঞ্চায়েত প্রধানও।
ফলে সন্দেশখালির ‘বাঘ’ কতটা জানতেন, আপাতত তা জানতেই মনোনিবেশ করছেন তদন্তকারীরা। শাহজাহানকে আরও আট দিন হেফাজতে পেয়েছে সিবিআই। তার মধ্যেই তাঁকে টানা জেরা চলবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy