গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আমেরিকায় নরেন্দ্র মোদী এবং জো বাইডেনের বৈঠকে কলকাতায় কারখানা স্থাপনের আলোচনা! প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বিবৃতি প্রকাশ হওয়া মাত্রই রবিবার চমকে উঠেছিল বাঙালি। তবে অতটা চমকায়নি নবান্ন।
নবান্ন কি জানত? জানত। এবং জানত না-ও। ‘সেমিকন্ডাক্টর কারখানা’ গড়ার ব্যাপারে দুনিয়ার অন্যতম নামী সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্ডারিজ়ের সঙ্গে কথাবার্তা চলছিল। এগোচ্ছিলও। কিন্তু দুই দেশের দুই শীর্ষনেতার বৈঠক থেকে সেই সংক্রান্ত কোনও ঘোষণা উঠে আসতে পারে, তা কল্পনায় ছিল না। সোমবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর এক্স হ্যান্ডলে জানিয়েছেন, মোদী-বাইডেনের ঘোষণায় যে বিনিয়োগের কথা প্রকাশিত হয়েছে, তার নেপথ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দীর্ঘ উদ্যোগ রয়েছে।
‘কোয়াড’ সম্মেলনে যোগ দিতে আমেরিকায় গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সম্মেলনের বাইরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাই়ডেনের বৈঠক হয় রবিবার। তার পরেই মোদীর সচিবালয় থেকে ঘোষণা করা হয়, কলকাতায় ‘সেমিকন্ডাক্টর কারখানা’ গড়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে দুই রাষ্ট্রনেতার। বিনিয়োগকারী হিসেবে নাম উঠে আসে দুনিয়ার অন্যতম নামী সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্ডারিজ়ের।
রাজ্য সরকার সূত্র খবর, এ নিয়ে লাগাতার প্রচেষ্টা বেশ কিছু দিন ধরেই জারি ছিল। সোমবার দুপুরের আগে যখন মমতার পোস্টের খসড়া তৈরির কাজ চলছিল, সেই সময়েই সরকারি এক আধিকারিক আনন্দবাজার অনলাইনকে বলছিলেন, ‘‘গ্লোবাল ফাইন্ডারিজ়ের সঙ্গে রাজ্য সরকারের একটা মউ (এমওইউ) হয়েছিল। কিন্তু তা এখনও পরিণতির জায়গায় যায়নি। তার মধ্যেই রবিবার আমরা ওই ঘোষণার কথা জানতে পারি।’’ যা থেকে স্পষ্ট, নবান্ন কেউই হয়তো এই ঘোষণার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। অন্য অনেক মউয়ের মতোই এটিকে ধরে নিয়েছিলেন অনেক কর্তা।
২০২১ সালে তৃতীয় বার সরকারে এসেই মমতা ঘোষণা করেছিলেন, এ বারে তাঁর ‘ফোকাস’ হবে শিল্পায়ন। সেই সময়েই তৈরি হয়েছিল ‘ডেটা সেন্টার পলিসি’। রাজ্য সরকারের এক কর্তার কথায়, ‘‘ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসে চিপ ব্যবহার করা হয়। সেই চিপ মূলত তৈরি করে চিন। কিন্তু সম্প্রতি সারা পৃথিবীতেই চিনে উৎপন্ন চিপ ব্যবহারের প্রবণতা নিম্নমুখী।’’ ‘সেমিকন্ডাক্টর’ হল সেই চিপ তৈরির অন্যতম উপাদান। এই প্রেক্ষাপটে আমেরিকার সংস্থার বিনিয়োগে বাংলায় ‘সেমিকন্ডাক্টর’ কারখানা নির্মাণ ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকেও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মত আমলা মহলের অনেকের।
মোদী এবং বাইডেনের বৈঠক থেকে কলকাতায় এই বিনিয়োগের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন মমতা। পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘‘গত বছরের গোড়া থেকেই রাজ্য সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি দফতর এবং ওয়েবেল ‘সেমি কন্ডাক্টর’ সংস্থাগুলিকে আর্জি জানাচ্ছিল। এই ধরনের চিপ তৈরির ছোট ছোট স্টার্টআপগুলিকে ওয়েবেল আইটি পার্কে জায়গাও দিয়েছে।’’ রাজ্য সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের সঙ্গে যুক্ত এবং সমন্বয় রেখে চলা এক কর্তার কথায়, ‘‘অ্যানালগ পদ্ধতিতে যে চিপ তৈরি হয়, তাতে বাঙালিদের বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। কারণ, এক দিকে বাঙালিরা ভাল ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়র হন। পাশাপাশি তাঁরা ভাল শিল্পীও হন। এই দু’টির মেলবন্ধন ‘সেমি কন্ডাক্টর’ শিল্পের জন্য উল্লেখযোগ্য।’’
গত বছর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে গ্লোবাল ফাউন্ডারিজ়ের আমেরিকার প্রতিনিধিরা কলকাতায় এসেছিলেন। তাঁরা গিয়েছিলেন ওয়েবেলের সদর দফতরে। তার পর থেকে একাধিক বার ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে মতামত বিনিময় হয়েছে। এই পর্বেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যলয়-সহ রাজ্যের একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওয়ার্কশপও হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে।
সেমিকন্ডাক্টর হল এমন এক ধরনের বস্তু, যা নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতে তড়িৎবাহী হতে পারে। মূলত বিভিন্ন ধরনের বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতিতে সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার করা হয়। মোবাইল হোক বা ক্যামেরা, কিংবা ল্যাপটপ, টিভি— এই যন্ত্রগুলিকে সচল রাখে এক বিশেষ ধরনের ‘চিপ’ বা ‘মাইক্রোচিপ’। এই ‘চিপ’ তৈরির ক্ষেত্রে একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হল সেমিকন্ডাক্টর। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বর্তমান বিশ্বে সেমিকন্ডাক্টর ক্ষেত্রের গুরুত্বও ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সারা দুনিয়ায় ‘সেমি কন্ডাক্টর’ শিল্পে গ্লোবাল ফাইন্ডারিজ় প্রথম তিনটি সংস্থার মধ্যে একটি। রাজ্য সরকার সূত্রে জানা গিয়েছে, এই কাজের জন্য ইতিমধ্যেই টেগোর টেক নামের একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাকে গ্লোবাল ফাইন্ডারিজ় অধিগ্রহণ করেছে। পাশাপাশি শাওমি, মাইক্রনের মতো সংস্থাও বিনিয়োগ করতে, বাংলায় আসছে। গ্লোবাল ফাউন্ডারিজ়ের মতো সংস্থার বাংলায় বিনিয়োগকে ‘উল্লেখযোগ্য’ বলে মনে করছে রাজ্য সরকার। তার কারণ, এই রকম একটি সংস্থা বাংলায় বিনিয়োগ করলে আন্তর্জাতিক শিল্পমহলে রাজ্য সম্পর্কে ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে দেবে বলে মত আমলা মহলের অনেকের। যা বাণিজ্য, কর্মসংস্থানের জন্য উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
তবে এখনও পথ চলা বাকি। প্রথমত, চুক্তি স্বাক্ষর হতে লাগবে। রাজ্যের শিল্প মহল আশা করছে, এ ধরনের একটা ‘বড়’ সম্ভাবনার জন্য রাজ্য সরকার দ্রুততার সঙ্গে যা যা কাজ করার করবে। এবং সাহায্য পাবে কেন্দ্রীয় সরকারেরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy