প্রতীকী ছবি।
আমি রামধনুর দু’প্রান্তের শিক্ষার্থীদের দেখেছি― গ্রাম থেকে আসা তরুণ-তরুণী, যাঁরা অষ্টম বা দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ক্ষেত্রে পেশাদার হওয়ার প্রশিক্ষণ নেন। আর এক দল, আইআইটি-তে স্নাতক শিক্ষার্থী। যাঁরা সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাগুলির একটিতে কৃতকার্য হয়েছেন। রামধনুর সেই ছটায় রয়েছেন আরও অনেকে। যেমন, প্রেসিডেন্সি, সেন্ট জেভিয়ার্স, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতীরাও। একটি সুতো যা তাঁদের সকলকে বেঁধে রাখে, তা হল ইংরেজি ভীতি। আঞ্চলিক স্তরের শিক্ষার্থীরা জীবনযুদ্ধে মুখোমুখি হয়ে আচমকা এমন পরিবেশে পড়েন, যেখানে সব কিছুই ইংরেজিতে হয়, সেখানেই তাঁরা ভয় পেয়ে যান এবং সব কিছু বুঝে ওঠা হয় না।
প্রথমত, উচ্চশিক্ষা বিশেষত ইঞ্জিনিয়ারিং, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও গণিতের পাঠ্যপুস্তক ইংরেজিতেই থাকে। দ্বিতীয়ত, ইংরেজিতে কথা বলতে পারাটা সামাজিক অবস্থানকে নির্ধারিত করে দেয়। জার্মানির কোনও রেস্তরাঁয় কেউ জার্মান ভাষায় অর্ডার দেওয়ার পরে তাঁকে মাথা নিচু করতে হবে না। এমনকি, যদি কোনও ওয়েটার ইংরেজিতে অর্ডার নিতে ব্যর্থ হন, তবে তাঁকে ক্ষমা চাইতে হবে না। অথচ কলকাতায়, কোনও ‘ফাইন ডাইনিং’-এ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললে আপনাকে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে কোণের টেবিলে ছেড়ে দেবে! তা ছাড়া শহুরে পটভূমি থেকে আসা শিক্ষার্থীদের এক অংশ যাঁরা ‘হিংলিশ’ বা ‘বেংলিশ’ পাঠে অভ্যস্ত, তাঁদের উদ্ধত মনোভাবই ইংরেজি কম জানা শিক্ষার্থীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
এ কারণেই শহরাঞ্চল বা গ্রামাঞ্চল থেকে আসা শিক্ষার্থীরা আত্মসম্মান হারানোর এবং বন্ধুত্ব স্থাপনে ব্যর্থতায় শঙ্কিত থাকেন। অন্যের কাছে নরম উপহাসের শিকার হয়ে, পড়াশোনা বুঝতে না পেরে এবং বিষয়টি সম্বন্ধে জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও ফলাফল খারাপ করায় নিজেদের নরম খোলসে ঢুকিয়ে নেওয়াই শ্রেয় মনে করেন। অতি সাধারণ পরিবারের এক জন শিক্ষার্থী, যিনি বহু বাধা টপকে এবং বাবা-মায়ের প্রত্যাশার ভার বহন করে উঠে এসেছেন, তাঁর কাছে এটি হৃদয় বিদারক পরিস্থিতি।
তবে দেখেছি, এমন পরিবেশে পড়েও বেশির ভাগ শিক্ষার্থী সময়ের সঙ্গে সে সব মোকাবিলা করে পড়াশোনায় তাঁদের সেরাটা অর্জন করেছেন।
এই অবস্থা যাতে না হয়, সে দিকটা নিয়ে সকলকেই ভাবতে হবে। স্কুলগুলিতে প্রাথমিক পর্যায় থেকে ইংরেজি শেখানো শুরু করা উচিত। সেটা ভাল ভাবে করুন এবং ইংরেজিতে অধ্যয়নের গুরুত্বের উপরে জোর দিন। অনেক শিক্ষার্থীর কাছে ইংরেজি নিয়ে যে মারাত্মক ভয় রয়েছে, তা দূর করুন। আমি দেখেছি, এক জন প্যারামেডিক ছাত্রকে ‘আমি সিনেমা পছন্দ করি’ বা ‘আমি কলকাতা যাই’ জাতীয় লেখা শেখানোর জন্য কয়েক সপ্তাহ ধরে লড়াই করতে হয় শিক্ষকদের। স্কুলগুলি কেন এত ব্যর্থ হবে? তা ছাড়া যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের বড় অংশ পড়তে যান, তাদের একটি ‘সেল’ স্থাপন করা দরকার। প্রথম দিনেই সেই ‘সেল’-এর সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার শিক্ষার্থীর যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া উচিত। যাতে তাঁকে সেখানে বিশেষ ক্লাস করিয়ে বিচ্ছিন্ন হওয়ার এবং অ্যাকাডেমিক ব্যর্থতার ভীতি সরিয়ে দেওয়া যায়। পাশাপাশি, শিক্ষকদেরও ক্লাসে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের দিকে বাড়তি নজর দেওয়া উচিত। তা ছাড়া আঞ্চলিক ভাষাকে গ্রহণ করতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এবং ম্যানেজমেন্টের উৎসাহ দেওয়া উচিত। অন্য শিক্ষার্থী, যাঁরা ইংরেজি জানেন তাঁদেরও বুঝতে হবে স্থানীয় ভাষা জানাটা গর্বের বিষয়।
কলকাতার একটি নামী প্রতিষ্ঠানে পড়া সদ্য তরুণ শিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যুতে আমি মর্মাহত। আমি নিশ্চিত নই যে, ইংরেজি জ্ঞানের অভাবই তাঁর মৃত্যুর পিছনে একমাত্র কারণ কি না। জীবনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের মাত্র দু’দিন আগে তিনি নতুন জায়গায় পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। তাঁর জন্য কোনও সাহায্যের পথ খোলা নেই, আবেগপ্রবণ হয়ে এমন মনে করার পক্ষেও খুবই অল্প সময় সেটি।
(লেখক স্কুল অব মেডিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, আইআইটি খড়্গপুরের ভিজিটিং প্রফেসর)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy