পুত্রহারা। সৌরভের দেহ বাড়ি পৌঁছনোর পরে শোকার্ত মা মিতাদেবী এবং বাবা সরোজ চৌধুরী। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
এক বার বনগাঁ। তার পর বারাসত। সেখান থেকে কলকাতা। ভাইয়ের খণ্ডবিখণ্ড দেহটা কোথায় রয়েছে, তার ময়নাতদন্ত হল কি না, তা জানতেই দিনভর জেরবার হতে হল প্রতিবাদী সৌরভ চৌধুরীর দাদা সন্দীপ ও তাঁর বন্ধুদের। ভাইয়ের নৃশংস মৃত্যু নিয়ে শোকের অবকাশটুকুও পেলেন না! টানাপড়েনে ক্ষুব্ধ সন্দীপ ও তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠদের অভিযোগ, সৌরভের মৃত্যুর তদন্তে সক্রিয় হওয়া দূরঅস্ত, পুলিশ-প্রশাসন তাঁর ভাইয়ের দেহ নিয়ে দিনভর অযথা হয়রান করেছে তাঁদের। এমনকী সৌরভের দেহ যে ময়নাতদন্তের জন্য কলকাতার এনআরএস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সে সম্পর্কেও পুলিশ-প্রশাসন স্পষ্ট ভাবে কিছু বলেনি পরিবারকে।
দিনভর হয়রানির শেষে দুপুর একটা নাগাদ পুলিশের কথা না শুনে সন্দীপ ও তাঁর বন্ধুরা সটান চলে আসেন এনআরএসে। এসে দেখেন, সৌরভের দেহ সেখানে আনা হয়েছে ময়নাতদন্তের জন্য। ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট চেয়েও পাননি তাঁরা। সৌরভের পরিবারের আশঙ্কা, শাসক দলের মদতে পুষ্ট দুষ্কৃতীদের আড়াল করতে পুলিশ ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাল্টেও দিতে পারে। পুলিশ অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
কী হয়েছে দিনভর?
সন্দীপ চৌধুরী ও তাঁর বন্ধুদের অভিযোগ, শনিবার সৌরভের দেহ উদ্ধারের পরে দুপুরে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সন্ধ্যায় দেহটি সৎকারের জন্য পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু সন্ধ্যায় পুলিশের তরফে জানানো হয়, উপযুক্ত ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ না মেলায় ময়নাতদন্ত করা যায়নি। রবিবার সকালে ময়নাতদন্ত হবে। সন্দীপের বন্ধু সৌরেন কর, শেখর মজুমদারেরা বলেন, “গত কাল সন্ধ্যায় জিআরপি-র অফিসারেরা আমাদের বলে দিয়েছিলেন, সকাল ১০টার মধ্যে বনগাঁ জিআরপি-তে চলে আসতে হবে। না হলে দেহ পাব না।”
সেই মতো সন্দীপরা সকাল ন’টা নাগাদ বনগাঁ যাওয়ার জন্য রওনা হন। শেখর বলেন, “পৌনে দশটা নাগাদ আমাদের গাড়ি যখন হাবরার কাছাকাছি, তখন বনগাঁ জিআরপি থেকে ফোনে বলা হয়, আপনারা জলেশ্বর মোড়ে এসে দাঁড়ান। মৃতদেহ বনগাঁ থেকে রওনা হয়ে গিয়েছে।” জলেশ্বর মোড়ে প্রায় আধ ঘণ্টা অপেক্ষার পরেও সৌরভের দেহ নিয়ে পুলিশ পৌঁছয়নি। এর পরেই সন্দেহ হয় সন্দীপদের। তাঁরা ফের বনগাঁ জিআরপি-র এক অফিসারকে ফোন করেন। তখন ওই অফিসার জানান, মৃতদেহ এনআরএসে চলে গিয়েছে। সেখানেই সন্দীপদের চলে যেতে বলেন তিনি। এর পরে সন্দীপরা রওনা হন এনআরএসের উদ্দেশে। সন্দীপরা যখন বারাসতের কাছাকাছি, তখন ফের তাঁদের ফোন করা হয় জিআরপি-র তরফে। বলা হয়, বারাসত জিআরপি-তে যেতে। সন্দীপ বলেন, “ওই সময়ে ফের ফোন আসার পরে আমরা আর কোনও মতেই পুলিশকে ভরসা করতে পারিনি। নিজেরাই বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ করতে শুরু করি। জানতে পারি, বারাসতে নয়, এনআরএসেই দেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখন আর পুলিশের পরামর্শের তোয়াক্কা না করে আমরা এনআরএসে যাই।” দুপুর ১টা নাগাদ হাসপাতালে পৌঁছে সন্দীপরা দেখেন, সৌরভের মৃতদেহ নিয়ে পুলিশও তখন ঢুকছে এনআরএসের মর্গে!
মর্গের বাইরে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন সৌরভের দাদা সন্দীপ। ছবি: রণজিৎ নন্দী
সৌরেন-শেখরদের অভিযোগ, “শুক্রবার রাতে সৌরভ অপহৃত হওয়ার পরে আমরা যখন পুলিশে অভিযোগ জানিয়েছিলাম, তখন পুলিশ আমাদের সহযোগিতা করেছিল। শনিবার সকালে সৌরভের মৃতদেহ উদ্ধারের পর থেকে পুলিশের ভূমিকা একেবারে পাল্টে গিয়েছে।” সৌরেনের অভিযোগ, “আমরা বহু দিন ধরেই ওই এলাকার সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছি। ওই দুষ্কৃতীরা সবাই শাসক দলের ছত্রচ্ছায়ায় রয়েছে। আমাদের বদ্ধমূল সন্দেহ, সেই কারণেই এখন পুুলিশ শাসক দলের চাপে সৌরভের খুনিদের আড়াল করতে চাইছে।”
এনআরএসে এসে সৌরেনদের সুরেই অভিযোগ করেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। তিনি বলেন, “এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ পাওয়া সত্ত্বেও এখনও পুলিশ অপরাধীদের গ্রেফতার করেনি। এমনকী, সৌরভের পরিবারের জন্য কোনও নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করা হয়নি।” তাঁর অভিযোগ, “তদন্তের নামে এখানে প্রহসন চলছে।”
দিনভর এই হয়রানির বহিঃপ্রকাশ হয় সৌরভের ময়নাতদন্ত শেষ হওয়ার পরে। ময়নাতদন্ত শেষ হওয়ার পরে সৌরভের সন্দীপের বন্ধু ও পরিবারের লোকেরা চিকিৎসকের কাছে প্রাথমিক রিপোর্টের দাবি জানান। কিন্তু চিকিৎসকের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, তাঁর পক্ষে ওই রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব নয়। এর পরেই সৌরভের পরিজনেরা ডাক্তারের গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। পরে কলকাতা পুলিশের বিশেষ বাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। রাজ্য বিজেপি-র সহ-সভাপতি সুভাষ সরকারের কথায়, “পুলিশের যা ভূমিকা, তাতে আমাদের সন্দেহ, ময়নাতদন্ত ঠিক মতো হয়নি। সৌরভ খুন হয়নি, এমন কিছুই ময়নাতদন্তের রিপোর্টে প্রমাণের চেষ্টা করছে পুলিশ।”
পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আর দিনভর একরাশ হয়রানি সম্বল করেই সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ সৌরভের মৃতদেহ রওনা হয় বামনগাছির উদ্দেশে। সৌরভের পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ দেহটি ময়নাতদন্তের জন্য ঠিক মতো সংরক্ষণ করেনি। সৌরেনরা এই প্রসঙ্গে বলেন, “পুলিশ প্রথমে আমাদের জানিয়েছিল, সৌরভের বাঁ-হাত আর পা পাওয়া যায়নি। এ দিন আবার জানিয়েছে, বাঁ-পায়ের খোঁজ মিলেছে! পুলিশ প্রথম থেকেই কোনও তথ্য সঠিক ভাবে দিচ্ছে না। রাজ্য প্রশাসনের উপরে আমাদের আর কোনও ভরসা নেই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy