ঘোড়ামারার মাস্টারমশাই।
তিন নদী পেরিয়ে ট্রলার যখন নতুন ঘাটে ভিড়ল, সেই মধ্যরাতেও জেগে ছিলেন গোটা দ্বীপের মানুষ। সে রাত, পরের গোটা দিনও, দু’দশক আগে অবসর নেওয়া এক শিক্ষকের জন্য চোখের জলে ভাসল এই বাংলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপের পথঘাট, পাড়া আর একের পর এক স্কুলবাড়ি। নবতিপর শিক্ষকের চিরবিদায়েও তাঁকেই আঁকড়ে ধরতে চাইল একের পর
এক গ্রাম।
বুধবার বিকেলে কাকদ্বীপের হাসপাতালে মারা গিয়েছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগর ব্লকের ঘোড়ামারার বাসিন্দা সতীশচন্দ্র জানা। পিছিয়ে থাকা অঞ্চলের তিন প্রজন্ম ধরে শিক্ষার আলো জ্বেলে রাখা ‘মাস্টারমশাইয়ের’ দেহ কাকদ্বীপ হাসপাতাল থেকে মাঝরাতে নিয়ে এসেছিলেন দ্বীপের বাসিন্দারা। প্রিয় শিক্ষকের শেষকৃত্যেও বৃহস্পতিবার সার বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল প্রতিটি গ্রাম, পাড়া। ছাত্র-ছাত্রী আর অভিভাবকেরা মনে করলেন, পাঠ্যবই থেকে জীবন—সর্বত্র আগলে রাখা নিজেদের প্রিয় অভিভাবককে।
শিক্ষকতার পাশাপাশি ক্ষয়িষ্ণু দ্বীপের স্কুলগুলির চার দেওয়ালের বাইরেও তিনি ছিলেন সকলের অভিভাবক। দ্বীপের মানুষ আর তাঁদের মাস্টারমশাইকে এক যতিহীন ব্যতিক্রমী সম্পর্ক বেঁধে ফেলেছিল। (মরদহের অপেক্ষায় মাঝরাতেও নদীর পাড়ে অপেক্ষা করেছেন তাঁর সন্তানসম ছাত্রেরা।) হাঠখোলা স্কুলের শিক্ষিকা চম্পা কারকের কথায়, ‘‘দুর্যোগে অনেক কিছু যায়। কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের শূন্যতা তার থেকে অনেক বেশি। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও এ গ্রামের মানুষকে জীবনের শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন সতীশবাবু।’’ দ্বীপের মহিলাদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের লক্ষ্যে স্কুলের ঘুরে ঘুরে স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন। সমবায়ের মাধ্যমে ঋণ দিয়ে ছাগল, মুরগি, হাঁস পালনের পথ দেখিয়েছিলেন তিনিই। ‘নেতাজি, ‘স্বামীজি’র মতো মনীষীদের নামে তাঁর তৈরি ১১টি গোষ্ঠী এখন তিন গুণ বেড়েছে। নিজেকেই প্রশ্ন, ‘‘ক্লাসে এসে ছাত্রদের সঙ্গে বসে কে দেখবেন আমাদের পড়ানো?’’
প্রাকৃতিক কারণে গত কয়েক দশকে অস্তিত্বের সঙ্কট ক্রমেই গভীর হয়েছে ঘোড়ামারায়। গত চল্লিশ বছর ধরে সেই দ্বীপেরই হাজার তিনেক বাসিন্দার স্কুলশিক্ষার প্রহরী ছিলেন প্রয়াত সতীশবাবু। এখানকার বাগপাড়ার বাসিন্দা সতীশবাবু প্রথম জীবনে যোগ দেন স্থানীয় রায়পাড়া জুনিয়র বেসিক স্কুলে। তার পরে পাশের গ্রাম হাটখোলা প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে। অবসরের প্রায় ২০ বছর পরেও সেই সম্পর্কে ছেদ পড়েনি। আমৃত্যু নিজের গ্রাম আর তার শিক্ষার পাহারা দিয়ে গিয়েছেন এই ‘শিক্ষাবন্ধু’। হাটখোলা স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা গায়ত্রী খাঁড়া গিরির কথায়, ‘‘গোটা কর্মজীবন এবং তার পরেও সহকর্মী, ছাত্র-ছাত্রী তো বটেই দ্বীপের গ্রামগুলিকে পিতৃস্নেহে আগলে রেখেছিলেন দাদা।’’ গায়ত্রীর মনে পড়ে, ‘‘সরস্বতী পুজোয় এসেও আমাকে তাড়া দিয়ে গিয়েছেন, বাচ্চাদের ‘ডাইনিং হল’টা নিয়ে অফিসে লেখ।’’
ঝুঁকির কারণে যে নদীতে দিনের আলো ফুরিয়ে এলে ফেরি চলে না, সেখানেও নৌকার ব্যবস্থা করেছিলেন দ্বীপের মানুষ। অভিভাবকের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ট্রলার দিয়েছিলেন মালিক অরুণ প্রামাণিক। দ্বীপের একমাত্র হাইস্কুল যে মিলন বিদ্যাপীঠের সভাপতি ছিলেন সতীশবাবু, তারই আংশিক সময়ের শিক্ষক সুরজিৎ করের কথায়, ‘‘আমরা জানতাম, কোথাও আটকে পড়ব না। আমাদের পথ দেখাবেন মাস্টারমশাই। হয়তো সেই ধারায় ইতি পড়বে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy