গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন বাসিন্দারা। রবিবার সন্দেশখালির ভাঙ্গিপাড়ায়। নিজস্ব চিত্র
এক হাতে শক্ত মুঠিতে ছেলে, অন্য হাতে আলুথালু শাড়ির আঁচলে মুখ চাপা দেওয়ার চেষ্টা। বিকেল ৩টে নাগাদ ভেড়ির পাড় ধরে সপরিবার মালঞ্চে বাপের বাড়ি রওনা হয়েছেন ছলনা মণ্ডল। ভেড়ির মাছ চাষি স্বামী রজনীর দু’চোখে আতঙ্ক। হাত-ভর্তি নিত্য দিনের গেরস্থালির মালপত্র। বাবা-মায়ের মধ্যবর্তী নিরাপদ আশ্রয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া মেয়ে। শনিবার বিকেল থেকে যার মুখে কোনও কথা নেই।
ভাঙ্গিপাড়া-কাণ্ডের পরে রজনীদের মতো আরও অনেক পরিবার আতঙ্কে শনিবার রাত থেকে গ্রাম ছাড়তে শুরু করেছেন। ছলনার কথায়, ‘‘চোখের সামনে গোটা ঘটনাটা ঘটে গেল। গুলি চলার সময়ে দরজা-জানলা এঁটে ভগবানের নাম নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। পুলিশ ছিল। কিন্তু কেউ কিছু করল না। এমন ঘটনা এ গ্রামে আগে কখনও দেখিনি।’’
তাই বলে বাপের বাড়ি চলে যাবেন? প্রশ্ন শুনে এত ক্ষণে মুখ খুললেন রজনী। বোঁচকাপত্তর মাটিতে নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, ‘‘উপায় কী, কাল যে আমার বাড়িতেও বোমা-গুলি এসে লাগবে না, তা কে বলতে পারে!’’ তবে একই সঙ্গে জানালেন, ছেলেমেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে রেখে নিজে ফিরে আসবেন গ্রামে। বেশি দিন বাড়ি খালি রাখলে এক চিলতে ভেড়ি, মাটির ঘরও দখল হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা গৃহকর্তার। বললেন, ‘‘আর দাঁড় করাবেন না। দিন থাকতে থাকতে এলাকা ছাড়তে চাইছি। অন্ধকারকেও ভয় করছে।’’
শনিবারের ঘটনার পরে রবিবার সকাল থেকে গোটা গ্রামের ছবিটা মিশ্র। এক দিকে ভয়, আতঙ্ক আর গুজব। কানে কানে ঘুরছে, ‘‘পাশের গ্রামে শান্তি মিছিল বেরিয়েছে। সেই মিছিলই নাকি এ গ্রামে ঢুকে ফের হামলা চালাবে।’’ কেউ বলছেন, ‘‘দূরে হাইওয়ের ধারে মাটির নীচ থেকে উদ্ধার হয়েছে মৃতদেহের স্তূপ।’’ একটা করে খবর আসছে, আর গ্রামবাসীরা ঘিরে ধরছেন সাংবাদিকদের। সঙ্গে আকুতি, ‘‘চলে যাবেন না। আপনারা চলে গেলে আবার হামলা হবে!’’
অন্য দিকে, গ্রামের মোড়ে পুলিশ, টিভি চ্যানেলের ওবি ভ্যান আর গাড়ির মেলা। ‘স্টোরি’ খুঁজতে গ্রামের আনাচ-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাংবাদিকেরা। সকলেই ‘সত্যি’ জানতে চাইছেন। কিন্তু ‘সত্যি’টা যে আসলে কী, তার তল খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তৃণমূল-বিজেপি, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে গ্রামের মানুষ যে বর্ণনা দিচ্ছেন, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যে ভাবে এক রাতের জমা রক্তের ছাপ দেখাচ্ছেন মেঠো পথে, তা যেন শুধু সিনেমায় হয়। দিনেদুপুরে সন্দেশখালিতে এ ভাবে বাস্তব চিত্রনাট্য তৈরি হবে, ঘটনার সময়েও তা বিশ্বাস করতে পারেননি অনেকে।
বন্দুক উঁচিয়ে গ্রামের আলপথ ধরে যখন ঘটনা ঘটছে, ভেড়ির ধারে মাচায় বসা বৃদ্ধা কুচোরানি মণ্ডল তখন বন্দুকবাজদের আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন। বলার চেষ্টা করেছিলেন, ‘‘বাবা, এমন করিস নে। রাজনীতির জন্য এ ভাবে কেউ প্রাণ নিয়ে খেলে?’’ রবিবার সকালে বৃদ্ধা কুচোরানির সঙ্গে দেখা হল মাটির দাওয়ায়। হাতে ব্যান্ডেজ, মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ চুঁইয়ে জমাট রক্ত টিপের মতো হয়ে আছে। বাধা দেওয়ায় এটাই তাঁর ‘উপহার’। দাওয়া থেকে উঠতে চেষ্টা করেও ঝিমিয়ে পড়লেন কুচোরানি। অবসন্ন গলায় বললেন, ‘‘পালানোর বয়স থাকলে চলি যেতাম বাবা। আমাদের গেরামে শয়তান ঢুকে পড়েছে।’’
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy